গল্পটা শুধুই নম্বরের নয় সংগ্রাম, স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরণের।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১০:৫৮:৫২
ভাঙা ঘর থেকে জিপিএ ৪.৮০ বদলে গেল বাস্তবতা: রাজীবের বাড়ির ছাউনির কিছু অংশ টিনের, কিছু জায়গায় পুরোনো পলিথিন দিয়ে ঢাকা। তার মধ্যে ছোট একটি খাট, এক পাশে বইয়ের তাক। এই ঘরেই রাজীব রাতভর পড়ে, দিনভর স্বপ্ন দেখে। রাজীব জানায় “জানতাম আমি সবার মতো সুবিধা পাব না। কিন্তু পড়ালেখা বন্ধ করলে সব হারাব। মা-বাবার কষ্ট যেন বৃথা না যায়, সেই চেষ্টাই করেছি।”
বাবা বললেন, ‘আজ মনে হচ্ছে জীবনটা ব্যর্থ নয়’
রাজীবের বাবা মোঃ হানিফ একজন দিনমজুর রিকশাচালক। তিনি বলেন, “ছেলেটা অনেক কষ্টে পড়েছে। আমি রিকশা চালিয়ে যা পাই, তার থেকে টাকা বাঁচিয়ে বই কিনেছি, মোবাইলে ডাটা কিনেছি, যেন সে অনলাইন ক্লাস করতে পারে। এখন মনে হয় জীবনটা ব্যর্থ নয়।” রাজীবের মা ফিরোজা বেগম আবেগ চাপা রাখতে পারেন না “অনেকদিন ভাত রান্না হয়নি শুধু তার খাতার টাকা জোগাড় করতে। আল্লাহ তার ফল দিয়েছে।”
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চোখে জল
রাজীবের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুজিবুর রহমান বলেন, “রাজীব আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। কোনো প্রাইভেট না পড়েও সে যা করেছে, তা সত্যিই অনুপ্রেরণার। আমরা তার জন্য একটি বিশেষ সম্মাননা দিব।” তিনি আরও জানান, রাজীবের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি সহায়তা প্রকল্প বাড়ানো উচিত।
কোচিং বা টিউশন নয়, সহায় হয়েছে ইউটিউব
রাজীব জানায়, তার পড়াশোনার বড় অংশ এসেছে অনলাইন ভিডিও দেখে। “ইউটিউবে Math XYZ, Amar Pathshala, এবং Class Room Bangladesh এর ভিডিও দেখে বুঝেছি অনেক কঠিন বিষয়। কখনো এক ভিডিও ৩–৪ বার দেখে শিখেছি। ফোন ছিল না, কাজের ছেলে কাদের ভাইয়ের মোবাইল চেয়ে নিতাম।” রাজীব প্রতিদিন লাইব্রেরিতে বসে ৪–৫ ঘণ্টা সময় দিত। বই জোগাড় করত বন্ধুদের কাছ থেকে।
স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হবার কিন্তু বাধা আছে অর্থ
রাজীব জানায়, তার স্বপ্ন মেডিকেল কলেজে পড়া। কিন্তু কোচিং, ভর্তি ফি ও অন্যান্য খরচ কীভাবে জোগাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাজীবের ভাষায়, “আমি এমবিবিএস পড়তে চাই। মানুষকে চিকিৎসা দিতে চাই। কিন্তু মেডিকেল কোচিংয়ের ফি শুনে ভয় পাই। কেউ যদি পাশে দাঁড়ায়, আমি হয়তো পারব।”
স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকর্মীরা পাশে দাঁড়াচ্ছেন
রাজীবের গল্প ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীবের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। ইউএনও শারমিন সুলতানা বলেন, “এমন প্রতিভা যেন হারিয়ে না যায়। উপজেলা প্রশাসন তার কোচিং এবং ভর্তি সহায়তা নিয়ে ভাবছে।” এছাড়া স্থানীয় সংগঠন “মানবতার ছায়া” রাজীবের জন্য একটি ল্যাপটপ ও শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রতিভাকে সংরক্ষণ জরুরি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাকিলা ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেক মেধা হারিয়ে যায়। রাজীবদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় স্কলারশিপ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা উচিত, যেন প্রতিভা টিকে থাকে।” তিনি আরও বলেন, “শুধু পরীক্ষা নয়, যারা সংগ্রাম করেও ফল করেছে, তাদের জন্য আলাদা কোটা থাকা উচিত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে।”
রাজীবদের গল্প হোক নতুন পথের প্রেরণা
রাজীবের মতো হাজারো ছেলে-মেয়ে আজ গ্রামে, শহরের অন্ধকার কোনায় পড়ছে, কাঁদছে, স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সুযোগ পায় না। রাজীব তার সাহস, সংগ্রাম আর নিষ্ঠার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে সুযোগ পেলে তারাও পারবে শীর্ষে উঠতে।শুধু প্রয়োজন একটু সহানুভূতি, একটু সহায়তা, আর রাষ্ট্রের মনোযোগ।