আল জাজিরার প্রতিবেদন
প্রকাশিত : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২০:০৫
সুদানে চলছে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। দেশটির সেনাবাহিনী ও দেশটির আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘাতের সময়কালে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় লাখে, আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত সোয়া কোটি মানুষ।
গণহত্যা, গণধর্ষণ আর দুর্ভিক্ষ যেন হয়ে উঠেছে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আর এর মধ্যেই আড়ালে চলছে এক দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা। অভিযোগ উঠেছে, আরএসএফ-এর চালানো ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধকে আড়াল করার পরিকল্পনা করছে ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী নীতি নির্ধারক গোষ্ঠী ‘দ্য ব্লব’। এমন চিত্র উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি অপরাধী মিলিশিয়া গোষ্ঠী, অর্থাৎ আরএসএফকে সমান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখাচ্ছে এই ‘ব্লব’। তার মানে, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সত্যকে বিকৃত করছে তারা।
ফলে সুদানের সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা পরিকল্পিতভাবে মুছে দেওয়া হচ্ছে। উপেক্ষা করা হচ্ছে বিশ্বের বিরাট এক মানবিক সংকটকে ।
সম্প্রতি সুদানের পশ্চিম দারফুরের এল-ফাশের শহর দখলে নিয়েছে আরএসএফ। সেখানে চালানো হচ্ছে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন। ফলে এই সংকটের যেন আর থামাথামি নেই, বরং ঘনীভূত হচ্ছে আরও।
জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট’ হিসেবে অভিহিত করলেও, এই ভয়াবহতার পেছনের বাস্তবতাকে পরিকল্পিতভাবে আড়াল করা হচ্ছে। অভিযোগের আঙুল উঠছে ওয়াশিংটনের এই প্রভাবশালী নীতি নির্ধারক ‘দ্য ব্লব’ গোষ্ঠীর দিকে।
কিন্তু কী এই ‘ব্লব’?
‘ব্লব’ শব্দটি প্রথম সামনে নিয়ে আসেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জাতীয় উপ-নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা বেন রোডস। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক অভিজাতদের সবার সামনে তুলে ধরতে গিয়ে তাদের ‘ব্লব’ বলে অভিহিত করেন তিনি। এই ‘ব্লব’ হলো এক ধরনের থিংক ট্যাংক। মার্কিন প্রভাবশালীদের মদদে তৈরি এই সংস্থা টিকিয়ে রাখছে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে। আর এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন, যখন কিনা তারা সুদানের ভয়াবহ চিত্রকে আড়াল করতে সেনাবাহিনী ও আরএসএফকে একই পাল্লায় মাপছে।
তাদের এই অবস্থানকে খালি চোখে দেখলে মনে হবে নিরপেক্ষতা। তবে সবার সামনে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে এক রাজনৈতিক কৌশল চালাচ্ছে ‘ব্লব’। ফলে গণহত্যা, শহর অবরোধ এবং পরিকল্পিত যৌন সহিংসতার মতো যুদ্ধাপরাধগুলোও যেন তাদের মদদে বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো অধিকাংশ হামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এর জন্য আরএসএফই মূলত দায়ী।
তবে এর বিপরীতে ‘ব্লব’-এর ‘উভয়পক্ষকে’ দায়ী করার প্রবণতা আরএসএফকে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি দিয়েছে, যার ফলে নির্ভয়ে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএফ।
‘ব্লব’ কেন এই কৌশল নিয়েছে?
‘ব্লব’-এর এই কৌশলের পেছনে রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। ‘ব্লব’-এর প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যের চেয়ে আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকেই বেশি অগ্রাধিকার দেয়, বিশেষ করে আরএসএফ-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে। এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যই একটি নিরপেক্ষতার আবহ তৈরি করা হয়, যা মূলত অপরাধীদের পক্ষেই কাজ করে।
আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরএসএফ নিজেদের একটি চতুর প্রচারণার ফাঁদে বিশ্বকে জড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা কৌশলগতভাবে নিজেদের ‘ইসলামপন্থার বিরোধী শক্তি’ এবং ইসরায়েলের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে। কিছু প্রভাবশালী পশ্চিমা কূটনীতিকও ব্লব-এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই যুদ্ধাপরাধী শক্তিকে বৈধতা দিচ্ছে এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে বিশ্বের কাছে।
এর চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করছে সুদানের সাধারণ মানুষ। একটি মিলিশিয়া বাহিনীকে সেনাবাহিনীর সমকক্ষ দেখিয়ে ওয়াশিংটনের ‘ব্লব’ শুধু সুদানের মর্মান্তিক বাস্তবতাকে বিকৃত করছে না, বরং দেশটির জনগণের ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাকেও মুছে দিচ্ছে।
লেখক
আমগাদ ফারেইদ এলতায়েব
নির্বাহী পরিচালক, ফিকরা ফর স্টাডিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর