 
                            প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ৬:৫৬:৫৬
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) দেশের উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে এমএসসি ইন ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এ উদ্যোগ শুধু একটি বিভাগীয় পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চলমান ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ফলাফল প্রস্তুতি, যাচাই, অনুমোদন এবং প্রকাশ সবকিছুই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছে। এতে যেমন সময় বাঁচছে, তেমনি ভুলের আশঙ্কা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে এবং ফলাফল প্রকাশ প্রক্রিয়া হয়েছে আগের তুলনায় আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও নির্ভুল।
এই সিস্টেমটি তৈরি ও পরিচালিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল কমিটির তত্ত্বাবধানে। সফটওয়্যারটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে শিক্ষক, বিভাগীয় প্রধান এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ লগইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারেন।
এই অর্জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে দেখছেন বুটেক্সের উপাচার্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার ড. জুলহাস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ বুটেক্সের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটি শুধু প্রযুক্তিগত রূপান্তর নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতেও এক বড় পরিবর্তনের সূচনা।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা চাই বুটেক্সের প্রতিটি একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে পুরোপুরি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হোক। শিক্ষার্থীরা যেন অনলাইনে তাদের ফলাফল, ফি, হল ব্যবস্থাপনা, এমনকি গবেষণা সম্পর্কিত কাজও করতে পারে—এ লক্ষ্যেই আমরা এগোচ্ছি।’
 
উপাচার্যের ভাষায়, ‘বুটেক্সকে আমরা শুধু টেক্সটাইল শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চাই না, আমরা চাই এটি হোক বাংলাদেশের প্রথম পুরোপুরি অটোমেটেড পাবলিক ইউনিভার্সিটি।’
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আগে ফলাফল প্রস্তুত ও প্রকাশে হাতে-কলমে অনেক ধাপ ছিল। এখন সেগুলো সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হচ্ছে। শিক্ষকরা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নম্বর ইনপুট দেন, সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোট নম্বর গণনা করে এবং ফলাফল তৈরি করে। এরপর অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ফলাফল প্রকাশিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো—শিক্ষার্থীরা এখন নিজ নিজ লগইন আইডি দিয়ে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল দেখতে পারছেন। এতে প্রশাসনিক জটিলতা অনেক কমে গেছে এবং স্বচ্ছতা বেড়েছে।’
এই অটোমেশন সিস্টেম বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে দেশের জনপ্রিয় আইটি প্রতিষ্ঠান হাইপারট্যাগ সলিউশন্স লিমিটেড, যারা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সার্ভার ম্যানেজমেন্ট ও ডেটা সিকিউরিটি বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করেছে।
হাইপারট্যাগ সলিউশন্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জানান, ‘আমরা বুটেক্সের টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে এমন একটি সিস্টেম তৈরি করেছি, যা নিরাপত্তা, স্কেলেবিলিটি এবং ব্যবহার-বান্ধবতার দিক থেকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে।’
এছাড়া ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড সফটওয়্যার প্রযুক্তি প্রদানে সহযোগিতা করেছে। তারা সিস্টেম আর্কিটেকচার, ডেটাবেস ডিজাইন এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলাফল প্রকাশ প্রক্রিয়া ম্যানুয়াল বা আংশিক ডিজিটাল ছিল। এতে সময় লাগত, ভুল হতো এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা দ্রুত ফলাফল জানতে পারতেন না।
বুটেক্সের এই উদ্যোগ সেই পুরনো ধারা ভেঙে দিয়েছে।
অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে এখন ফলাফল প্রকাশের সময় এক সপ্তাহ থেকে কমে এসেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টায়। শিক্ষার্থীরা যে কোনো স্থান থেকে অনলাইনে লগইন করে তাদের ফলাফল দেখতে পারছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অটোমেশনভিত্তিক এই সিস্টেম শুধু ফলাফল প্রকাশে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
আগামী মাসের মধ্যে এটি ধাপে ধাপে আরও বেশ কিছু প্রশাসনিক ও একাডেমিক শাখায় চালু করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে—সুপার ইউজার মডিউল, ভর্তি কমিটির চেয়ারম্যান মডিউল, হিসাব প্রধান মডিউল, বিভাগের প্রধান মডিউল, ফ্যাকাল্টি মেম্বার মডিউল, ব্যাচ কো-অর্ডিনেটর মডিউল, শিক্ষার্থী মডিউল, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মডিউল, হল প্রোভোস্ট এবং হল ব্যবস্থাপনা মডিউল, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা মডিউল, স্টোর/ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট মডিউল, কনফারেন্স এবং জার্নাল ম্যানেজমেন্ট মডিউল, ই-লার্নিং পোর্টাল (এলএমএস), আইসিটি সেকশন, একাডেমিক সেকশন, প্রোগ্রাম এবং কোর্স, সেমিস্টারে ভর্তি, ভর্তি বাতিল, মূল সনদপত্রের সাময়িক পুনঃপ্রত্যর্পণ, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষা সম্পর্কিত কার্যক্রম, শিল্পসংযুক্তি, প্রজেক্ট কাজ, ফর্ম, ফরম্যাট, সার্টিফিকেট, টেস্টিমোনিয়াল, অ্যালামনাই ডেটাবেস, ফ্যাক্টরি ডেটাবেস, শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাই ফিডব্যাক (স্টেকহোল্ডার হিসেবে), ফ্যাকাল্টি মেম্বার মডিউল, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মডিউল, গবেষণা পরিচালক মডিউল, টেস্টিং সার্ভিস মডিউল, প্রশাসনিক মডিউল, পরিকল্পনা ও ক্রয় মডিউল, সাপোর্ট সার্ভিস/হেল্প লাইন, পরিবহন ও লজিস্টিকস, মোবাইল অ্যাপস, অডিট সেকশন, প্রোক্টোরিয়াল বডি এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ।
এই বিভাগগুলো সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হলে, বুটেক্স হবে দেশের প্রথম পুরোপুরি অটোমেটেড পাবলিক ইউনিভার্সিটি, যেখানে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে আর কোনো ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া থাকবে না।
একজন শিক্ষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বুটেক্সের মতো একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় যদি নিজস্ব উদ্যোগে এমন অটোমেশন সিস্টেম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে তা দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিজিটাল রূপান্তরের পথ দেখাবে।”
এক এমএসসি শিক্ষার্থী বলেন, ‘আগে ফলাফল প্রকাশের জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করতে হতো। এখন লগইন করেই তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যাচ্ছে। এতে সময় বাঁচছে, আর ভুলের ভয়ও নেই।’
আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘সিস্টেমটি একদম সহজ। আমরা নিজেরাই ফলাফল যাচাই করতে পারছি। এটা সত্যিকারের অটোমেটেড বুটেক্সের সূচনা।’
সিস্টেমটিতে উন্নত সার্ভার আর্কিটেকচার ও ডেটা এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ফলাফল সংক্রান্ত তথ্য সুরক্ষিত থাকে।
হাইপারট্যাগ সলিউশন্সের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সার্ভারগুলো ক্লাউড-সমর্থিত এবং ডেটা ব্যাকআপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
হাইপারট্যাগের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘প্রতিটি লেনদেন বা তথ্য পরিবর্তনের সময় একটি ডিজিটাল লগ তৈরি হয়, যা সিস্টেমকে সম্পূর্ণ অডিটেবল করে।’
বুটেক্স কর্তৃপক্ষের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো একটি স্মার্ট টেক্সটাইল ক্যাম্পাস গড়ে তোলা। যেখানে থাকবে—স্মার্ট ক্লাসরুম ও ই-লার্নিং সিস্টেম, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও অনলাইন রিসোর্স, ছাত্র-শিক্ষক পোর্টাল, রিয়েল-টাইম উপস্থিতি ট্র্যাকিং, স্বয়ংক্রিয় ফি ও প্রশাসনিক লেনদেন ব্যবস্থা।
উপাচার্য ড. জুলহাস উদ্দিন বলেন, ‘বুটেক্সকে আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, প্রশাসনের ক্ষেত্রেও স্মার্ট করে তুলতে চাই। আমরা চাই প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি প্রক্রিয়া হোক স্বচ্ছ, দ্রুত ও প্রযুক্তিনির্ভর।’
বুটেক্সের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে প্রযুক্তি শুধু সহযোগী নয়, বরং একাডেমিক প্রশাসনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল মডেলে চলে যাবে।