“ছবির কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তার প্রভাব হয় লাখো শব্দের চেয়েও বেশি
প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২৫, ৩:৪৩:২৫
লেখক:
“ছবির কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তার প্রভাব হয় লাখো শব্দের চেয়েও বেশি।”
এই কথাটিই যেন প্রতিদিন প্রমাণ করে চলেছে ফটোগ্রাফির শক্তি। একটি নিঃশব্দ চিত্র কখনও শিশুদের কান্না, কখনও কৃষকের হাসি, আবার কখনও প্রতিবাদী মুখ হয়ে ওঠে একটি জাতির অব্যক্ত চেতনাবোধের বাহক। বাংলাদেশের মতো আবেগপ্রবণ ও সংগ্রামী দেশে ছবির গুরুত্ব এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।
ফ্রেমের ভেতর এক বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি বারবার বদলেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে নিয়েছে কিছু অনবদ্য ডকুমেন্টারি ফটো। সত্তরের দশকে যুদ্ধকালীন আলোকচিত্রীদের তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবি আজ শুধু ইতিহাস নয়, জাতিস্মৃতি। ডেভিড বার্গম্যান, রশিদ তালুকদার কিংবা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকির মতো ফটোগ্রাফাররা এক একটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন শত শত শহীদের আর্তনাদ।
একটি বিখ্যাত ছবি যেখানে একজন মা কোলে শিশুকে নিয়ে সীমান্ত পার করছেন, আর দূরে ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম এই একটি চিত্রই বুঝিয়ে দেয় যুদ্ধের ভয়াবহতা। সেই ছবি এখনো ইউনেস্কোর বিভিন্ন নথিপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ক্যামেরার চোখে রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে বাংলাদেশকে। কিন্তু তা বিশ্ববাসীর চোখে আসে চিত্রসাংবাদিকদের ক্যামেরার মাধ্যমে।
একটি ভাইরাল হওয়া ছবি একটি শিশু কাঁদছে, পেছনে তার পিতা-মাতার নিথর দেহ। এ যেন মানবতার চরম হতাশার প্রতিচ্ছবি। এই ছবি ছড়িয়ে পড়ে আল জাজিরা, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি তখন হয়ে ওঠে মানবিকতা আর আশ্রয়ের প্রতীক।
ফটোগ্রাফার তাসনিম জারিন বলেন, "ছবি শুধু রং আর আলো নয়, এটি জীবনের আর্তি। আমি চাই আমার ক্যামেরা এমন কিছু দেখাক, যা শব্দে বোঝানো সম্ভব নয়।"
শহুরে জীবনের গল্পও ছবি বলে
মেগাসিটির ভেতর লুকানো হাজারো গল্প। ভোরে হাঁস-মুরগি নিয়ে বসা মা, গরম রোডে হাঁটতে থাকা ছোট বাচ্চা, ফ্লাইওভারের নিচে বই হাতে পথচলা শিক্ষার্থী সবই ছবির গল্প।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘Humans of Dhaka’ নামে একটি পেজ নানা পেশার মানুষের ছোট ছোট জীবনের মুহূর্ত ছবির মাধ্যমে তুলে ধরছে। এই ধরনের ছবি প্রমাণ করে বাংলাদেশ শুধু সমস্যার দেশ নয়, সম্ভাবনারও।
ছবির শক্তি: আবেগের সেতু
একটি ভালো ফটো শুধু দেখায় না, অনুভব করায়। দারিদ্র্য, পরিবেশ বিপর্যয়, রাজনৈতিক দুর্নীতি কিংবা গণআন্দোলনস বকিছুর হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে একটি নিখুঁত মুহূর্তের ক্যামেরা শট।ছবির এই ভাষা সাংবাদিকতা, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে। UN, UNICEF, বা Red Cross তাদের অনেক রিপোর্টে এখন বাংলাদেশের ডকুমেন্টারি ফটো থাকে দৃশ্যত প্রমাণ হিসেবে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলাচ্ছে বাস্তবতা
আজকের দিনে ডিজিটাল ক্যামেরা, ড্রোন এবং AI photo editing বদলে দিচ্ছে ফটোগ্রাফির ধরন। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রশ্নও উঠছে এই ‘রঙিন সত্য’ আসলেই সত্য কি?
ফটোগ্রাফার তানভীর রাকিব বলেন, “প্রযুক্তি সাহায্য করে, কিন্তু অনুভূতি তো প্রযুক্তি জানে না। ছবিকে বাস্তব রাখতে হলে মন রাখতে হয়।”
একটি ছবি বদলাতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি শুধু শিল্প নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, একটি জাতীয় স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। একটি শিশুর হাহাকার, একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখের জল, কিংবা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ এই সবই আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়: আমরা কাদের জন্য লড়ছি, কেন বাঁচছি।❝একটি ছবিই যদি পারে হাজার কথা বলতে, তবে একটি সত্য ছবি কি বদলে দিতে পারে ভবিষ্যৎ?❞
শুধু সময়ের অপেক্ষা।