যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ উত্তেজনার মাঝে বিচক্ষণ অবস্থান, রপ্তানি স্বার্থেই নয় কূটনৈতিক ভারসাম্যের দিকেও নজর
প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৫:০৬
বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা শেষে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এতে করে বাংলাদেশকে বর্তমানে গড়ে ৩৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এই হার এখনো তুলনামূলকভাবে সহনীয়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে বাণিজ্যে বড় কোনো ধস নামার সম্ভাবনা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে জটিলতা নিরসনে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির উদ্বেগ প্রশমনের চেষ্টার পাশাপাশি, অন্যদিকে দেশের অন্যান্য বৈদেশিক বাণিজ্যিক অংশীদারদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে জিওপলিটিকাল ভারসাম্য রক্ষা করে চলার কৌশল গ্রহণ করা হয়। এই পদক্ষেপের বাস্তব প্রভাব সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদার যেমন চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থানের ওপর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “যুক্তরাষ্ট্র শুল্কহার নির্ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু আলোচনা এখনো চলমান। এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। কিছু বিষয়ে তাৎক্ষণিক ঐকমত্য হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের পথে এবং কিছু নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।” তিনি আরও বলেন, বর্তমান হারের ওপর নির্ভর করে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই, বরং সম্পর্কের অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে এই হার ভবিষ্যতে কমতেও পারে, আবার বেড়েও যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে গম, সয়াবিন ও জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত এবং মার্কিন কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনা। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে আরও বেশি মার্কিন পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত করার দিকেও সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি কমানো বা মার্কিন মোটরগাড়ির ওপর শুল্ক হ্রাসে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে, সামরিক সরঞ্জাম কেনা নির্ভর করে প্রয়োজন, মূল্য ও শর্তের ওপর। বাংলাদেশ বিভিন্ন উৎস থেকে সরঞ্জাম কেনার নীতিগত অবস্থানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তা বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে। মোটরগাড়ির শুল্ক হ্রাস বিষয়ে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিলে জাপানকেও দিতে হবে, যা মার্কিন গাড়ির জন্য বিশেষ সুবিধা নয়, বরং বাংলাদেশ রাজস্ব হারাবে।
মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন কোম্পানির প্রসঙ্গ উঠলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে এবং ধাপে ধাপে অন্যগুলোর প্রতিও আগ্রহ রয়েছে, তবে কিছুটা সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ২০ শতাংশ হার বেছে নিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হিসাবে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ, আর মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ হার নিজস্বভাবে নির্ধারণ করেছে, তবে তারা সেবাখাতে বাংলাদেশের প্রতি বছরের বিপুল অবদানকে বিবেচনায় নেয়নি।
আলোচনার বিষয়বস্তু গোপন রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে বাংলাদেশ একটি নন-ডিসক্লোজার চুক্তি (NDA) সই করেছে। এই শর্ত অনুযায়ী, আলোচনা সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) গ্যাট আর্টিকেল ২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব সুবিধা দিচ্ছে, তা অন্যদের না দিয়েও বৈধভাবে কার্যকর রাখা যাবে। এই সুবিধার বিষয়টি WTO-কে জানানো হবে।
এই শুল্ক আলোচনাকে কেবল অর্থনৈতিক বলেই দেখছেন না বিশ্লেষকরা; বরং এতে ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও জড়িত রয়েছে। শ্রমিক অধিকার, নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব, ডিজিটাল অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। চীনের নাম কোনো শর্তে উল্লেখ করা না হলেও তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনকে বিবেচনায় রেখে সতর্ক অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, “আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি এবং যুক্তরাষ্ট্র তা মূল্যায়ন করেছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভারসাম্য রক্ষা।”
অন্যদিকে, সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, “চুরি-জালিয়াতি ও টাকা পাচার বন্ধ করা গেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মালিকরা যদি সেই অর্থ শ্রমিক ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেন, উৎপাদনশীলতা বাড়বে।” তিনি রাজনৈতিক সংস্কার ও দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।