সংকটের চাপে অর্থনীতি টালমাটাল, তবে রপ্তানি, কৃষি ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বে উঠে আসছে নতুন সম্ভাবনা। প্রশ্ন উঠছে এটা কি শুধুই ধোঁয়াশা, না ভবিষ্যতের ভরসা?
প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০২৫, ২:০২:২৮
গ্লোবাল ফিনডেক্স রিপোর্ট ২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগণের মধ্যে মাত্র ৪৩ শতাংশের ব্যাংক বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখানে ২০২১ সালে এই হার ছিল ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ, তিন বছরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কমেছে ১০ শতাংশ পয়েন্ট। বিশ্বব্যাপী আর্থিক অন্তর্ভুক্তি যেখানে বেড়েছে, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী ভারতের ব্যাংক অন্তর্ভুক্তির হার ৮৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৮০ শতাংশ, আর বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংক জানায়, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) হিসাবধারীর হার ২০২১ সালের ২৯ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। ব্যাংক হিসাবধারীর হারও ২৪ থেকে কমে ২৩ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এনআইডি ভিত্তিক একক হিসাব চালুর ফলে বহু ভুয়া ও অকার্যকর অ্যাকাউন্ট বাতিল হওয়ায় পরিসংখ্যানে এই হ্রাস দেখা যাচ্ছে।
নারী-পুরুষ অন্তর্ভুক্তির ব্যবধানে বৈষম্য বেড়েছে
আলোচ্য প্রতিবেদনে আরও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে নারী-পুরুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পার্থক্য নিয়ে। ২০২১ সালে ‘জেন্ডার গ্যাপ’ ছিল ১৯ শতাংশ পয়েন্ট, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে। বর্তমানে নারীদের মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ৫৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১২ কোটি ২৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের কোনও ধরনের ব্যাংক বা আর্থিক হিসাব নেই। ফলে বাংলাদেশ এখন সেই আটটি দেশের মধ্যে রয়েছে, যেখানে অধিকাংশ মানুষ এখনও ব্যাংকবহির্ভূত অবস্থায় রয়েছে।
রাজস্ব ঘাটতিতে টালমাটাল অর্থনীতি
অন্যদিকে, রাজস্ব আদায়েও ধস নেমেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টানা ১৩ বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা কম। রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারের ব্যয় সংকোচ, উন্নয়ন প্রকল্পে বিলম্ব, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও ঋণনির্ভরতা বেড়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন। সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “বর্তমান কাঠামো দিয়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। কর ফাঁকি ও অব্যাহতির সংস্কৃতি রাজস্ব ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে।” তার মতে, শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কর ফাঁকির কারণে সরকার ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতির চক্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করছে, যার ফলে বাজারে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) মাত্র ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ হ্রাস পেয়েছে।
সংকটের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সরকারি ব্যয়ে শৃঙ্খলা ও সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। জ্বালানি, পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে পদ্মা ও যমুনা রেলসেতু চালুর ফলে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তি বাড়ায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে আশাবাদের বার্তা
সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহানেস জুট বলেন, “বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে।” তিনি জানান, ব্যাংক খাত ও রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে তারা আশাবাদী। বিশ্বব্যাংক চট্টগ্রাম বন্দর, লালদিয়া টার্মিনালসহ অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কর ব্যবস্থার সংস্কার, রাজস্ব আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং নারী-পুরুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বৈষম্য দূর করতে হবে।