প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ৪:৪৪:২১
উপবৃত্তি না পাওয়ায় পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিচ্ছে হাজারো শিশু বেঁচে থাকার সংগ্রামে শিক্ষার অধিকার হারিয়ে ফেলছে অর্থহীনতা
কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকা থেকে | মে ২০২৫
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। মাত্র ৯ বছর বয়সী রুনা, পড়ত স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আজ সে ঢাকার মিরপুরে এক বাসায় গৃহকর্মে কাজ করে। মাসে মেলে ১৫০০ টাকা। অথচ সে স্কুল ছেড়েছে মাত্র ১০০ টাকার উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। তার মা হালিমা খাতুন বলেন, “আগে উপবৃত্তি আসতো, বই কেনা যেত। এখন কিছুই আসে না। ওকে কাজে দিতে বাধ্য হয়েছি।” এমন ঘটনা এখন বিচ্ছিন্ন নয়। দেশের হাজার হাজার শিশু মাত্র ১০০ টাকার জন্য স্কুলছুট হচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে গৃহকর্মে বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে। বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি জাতীয় নৈতিক সংকট।
উপবৃত্তির অর্থ না পাওয়ায় ছিঁড়ে যাচ্ছে পড়ার ধারা
সরকারি উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মা বা অভিভাবকের মোবাইল নম্বরে মাসে ১০০ টাকা করে পাঠানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে অনেক পরিবার মাসের পর মাস কোনো অর্থ পাচ্ছে না। BANBEIS-এর (বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে ১০ লাখের বেশি উপবৃত্তি-অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহশ্রমিক বা দৈনিক আয়ের কাজে যুক্ত হয়েছে।
ঢাকার বাস্তবতা আরও ভয়াবহ: ঢাকার মিরপুর, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অনুসন্ধানে দেখা গেছে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা গৃহকর্মে নিযুক্ত অনেক শিশুই আগে স্কুলে পড়ত। এক গৃহকর্ত্রী বলেন, “মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে পড়তো। মা এসে বলে ‘আপা, উপবৃত্তি বন্ধ হইছে, এখন আর পড়াতে পারি না।’ তাই ওকে নিয়ে এলাম।” সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ-এর এক অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট (ফেব্রুয়ারি ২০২৫) অনুযায়ী, শুধু ঢাকায় ২০ হাজারের বেশি শিশু গৃহকর্মে যুক্ত, যাদের মধ্যে অন্তত ৪০% আগে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল।
স্থানীয় শিক্ষকরা বলছেন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার এক সহকারী শিক্ষক বলেন, “আমরা নিয়মিত তালিকা হালনাগাদ করি, কিন্তু মোবাইল নম্বর ভুল, মা-বাবার আইডি মেলে না এরকম বহু সমস্যায় উপবৃত্তি আটকে থাকে। অভিভাবকেরা হতাশ হয়ে সন্তানকে স্কুল থেকে তুলে নেয়।” তিনি বলেন, “একজন শিক্ষার্থীর জন্য মাসিক ১০০ টাকা হয়তো নগণ্য, কিন্তু দরিদ্র পরিবারে সেটিই বই, কলম, এমনকি দুপুরের খাবারের মূল্য হয়ে ওঠে।”
শিক্ষা অধিকার: বাস্তবতা ও নীতির ফাঁক
শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মত: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদা আহমেদ বলেন, “১০০ টাকা শুধু টাকা নয় এটা এক ধরনের প্রতীক, যা একজন শিশুকে শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাখে। সেই টাকার গুরুত্ব না বুঝলে আমরা প্রজন্ম হারাব।” তিনি আরও বলেন, “উপবৃত্তি ডিজিটাল হলেও মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। শিশু শিক্ষায় শুধু প্রকল্প নয়, দরকার সামাজিক দায়বদ্ধতার কাঠামো।”
কী করা উচিত?
১০০ টাকায় একটি শিশু পড়তে পারে, আবার সেই টাকাই বন্ধ হলে সে হয়তো বাড়ির কাজ, দোকানের পিছনে অথবা রাস্তায় দিন কাটায়। শিক্ষা অধিকার কেবল কাগজে থাকলে হবে না তা বাস্তবে প্রতিটি শিশুর জীবনে পৌঁছাতে হবে, নইলে জাতীয় উন্নয়ন কেবল নীতিগত প্রচারণা হয়েই থাকবে।