গত দশ বছরে কোরবানির চামড়ার বাজার এক অব্যবহৃত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয়েছে। দাম প্রায় ৮৫% কমলেও, রপ্তানি ৫০% কমে যাওয়ার কারণ কি শুধুই বাজারের ওঠানামা, নাকি গভীর আর্থিক সংকট?
প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২৫, ১:৫১:৪৪
কোথায় গেল বাজার?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরবানির চামড়ার মূল্যহ্রাসের পেছনে কয়েকটি জটিল কারণ রয়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক চামড়া শিল্পে প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ ও সিন্থেটিক চামড়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত চামড়া শিল্পের উন্নয়ন এবং মান বজায় রাখতে ব্যর্থতা। তৃতীয়ত, বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিন্থেটিক চামড়ার ব্যবহার বিশ্বজুড়ে বাড়ছে, যা চামড়ার প্রকৃত চাহিদাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে। আবার পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোর হওয়ায়, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধা বেড়েছে।
শিল্পের ভিতর থেকেই সংকটের চিত্র
চামড়া প্রক্রিয়াজাত শিল্পের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ রফিক বলেন, “মূল্য পতনের পেছনে রয়েছে শিল্পের আধুনিকায়নের অভাব ও পুরনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার। পাশাপাশি, প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মানের স্থায়িত্ব নেই। আমাদের কারিগরি দক্ষতা ও বাজার গবেষণা আরও উন্নত করতে হবে।” আরো বলেন, বাংলাদেশে অনেক ছোট কারখানা এখন ঝুঁকিতে। তারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করতে পারছে না। ফলে ক্রেতাদের আস্থা কমছে।
রপ্তানি সংকট: অভ্যন্তরীণ কারণ ও বৈশ্বিক প্রভাব
রপ্তানিতে ৫০% হ্রাসের পেছনে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, পাশাপাশি চামড়ার ওপর কড়া পরিবেশগত বিধি-নিষেধ। ইউরোপ ও আমেরিকায় চামড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রভাবিত হয়েছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাও চলায় বাংলাদেশি পণ্য সঠিক দামে বিক্রি হচ্ছে না। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক ইয়ুকি ফুজিওকা বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দেশীয় উৎপাদন আধুনিক না হয়, তাহলে মান ও পরিমাণ দুইতেই পিছিয়ে পড়তে হবে। বাংলাদেশ চামড়া শিল্পে এই সমস্যার মুখোমুখি।”
পথ খোঁজা প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চামড়া উৎপাদন নয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন গবেষণায় বিনিয়োগ না করলে চামড়া শিল্প ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সরকারেরও উচিত পরিকল্পিতভাবে শিল্পের আধুনিকায়ন ও বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী নতুন বাজার অন্বেষণ করা।
“টেকনোলজি ও মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া চামড়ার শিল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।” মোহাম্মদ রফিক, চামড়া কারখানা মালিক
শেষ কথা:
এক দশকের এই মূল্য পতন শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সংকেত। নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা ছাড়া চামড়ার বাজারে টিকে থাকা কঠিন। সময় এসেছে পরিবর্তনের, নইলে হারাবো এই শিল্পকেই।
কোরবানির চামড়া আজ মূল্যহীন, কিন্তু সচেতন উদ্যোগে তা আবার জয়গাথা রচনা করতে পারে।