বিয়ে নয়, স্বপ্নকেই বেছে নিয়েছে যে সাহসী স্কুলছাত্রী।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৪৪:০৫
২০২৫ সালের শিক্ষাব্যবস্থার মেগা রিফর্ম যখন দেশজুড়ে আলোচিত, তখন এক কিশোরী এই নতুন শিক্ষানীতিকে হাতিয়ার করে লড়ছে নিজের ভবিষ্যতের জন্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বাল্যবিয়ের মুখে পড়ে সুমাইয়া খাতুন। কিন্তু সে হার মানেনি নিজের স্বপ্ন, শিক্ষা আর আত্মসম্মানের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সঙ্গে জানিয়ে দেয়, “আমি এখনই বিয়ে করব না, আমি স্কুলে ফিরব।”
মুখস্তবিদ্যার বদলে বুঝে শেখার সুযোগ
সুমাইয়ার এই প্রত্যাবর্তন কেবল তার একক গল্প নয়, বরং এটি ২০২৫ সালের নতুন শিক্ষা কাঠামোর প্রতিফলন। মুখস্ত নির্ভর পাঠ্যক্রমের পরিবর্তে এখন শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে যুক্তি, বিশ্লেষণ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। নবম শ্রেণিতে ফিরেই সুমাইয়া বলল, “আগের বইগুলো বুঝতাম না, শুধু মুখস্থ করতে হতো। এখন প্রজেক্ট করি, গল্প লিখি, ক্লাসে আলোচনা হয় এসব আমার খুব ভালো লাগে।”এনসিটিবির নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী এখন ছাত্রীরা প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট ও রিসার্চে অংশ নিচ্ছে। এতে করে মেধার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, যা সুমাইয়ার মতো অনেক মেয়েকে তৈরি করছে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী অবস্থানে।
অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তনই মূল চ্যালেঞ্জ
সুমাইয়ার বাবা মজিবুর রহমান বললেন, “প্রথমে বিয়ের চিন্তা করেছিলাম। এলাকায় অনেকেই মেয়েদের বেশি পড়াতে চায় না। কিন্তু মেয়ে যেভাবে বলল ‘বিয়ে হলে পড়াশোনা শেষ’, তখন থমকে যাই।”এই ঘটনা শিক্ষানীতির বাস্তব রূপান্তরকেই তুলে ধরছে। নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী কেবল পাঠগ্রহণ করে না, বরং নিজের কথাও বলতে পারে। আর এই কথাগুলো অভিভাবকরা শুনতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষাবিদ ডা. তাহমিনা ফেরদৌস বলেন, “২০২৫ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল তাদের মেধা নয়, আত্মপরিচয়কেও নির্মাণ করছে। সুমাইয়ার মতো সাহসী কিশোরীরা সমাজে নতুন আলো ছড়াচ্ছে।”
‘ডিজিটাল ল্যাব’ ও ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে নতুন সুযোগ
সুমাইয়ার স্কুলে চালু হয়েছে ‘ডিজিটাল ল্যাব’। এখানে মেয়েরা ইন্টারনেট ব্রাউজ করে, ভিডিও দেখে শিখে, প্রেজেন্টেশন তৈরি করে। ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে নতুন ধরনের বই পড়ে তারা শিখছে চিন্তা করতে। প্রধান শিক্ষক বলেন, “আগে মেয়েরা ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকত। এখন প্রশ্ন করে, উপস্থাপনা দেয়। বিশেষ করে বাল্যবিয়ে রোধে আমরা যে কর্মশালা করি, সেখানে তারা নিজেরাই নেতৃত্ব দেয়।”
মেয়েদের প্রস্তুতির পাঁচটি দিক নতুন শিক্ষাব্যবস্থায়
২০২৫ সালের শিক্ষানীতির আলোকে মেয়েদের পাঁচটি প্রস্তুতিমূলক ক্ষেত্র উঠে আসছে, যা সুমাইয়ার ক্ষেত্রেও সত্য প্রমাণিত:
নিয়মিত পড়াশোনা ও অংশগ্রহণ: ধারাবাহিক মূল্যায়নের কারণে সারা বছরই সক্রিয় থাকতে হচ্ছে।
যুক্তিভিত্তিক চিন্তা: প্রজেক্ট ও কেস স্টাডির মাধ্যমে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ বাড়ছে।
প্রযুক্তি দক্ষতা: ভার্চুয়াল ক্লাস ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারে বেড়েছে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস।
উপস্থাপন ও কমিউনিকেশন স্কিল: এখন তারা নিজেরা ক্লাসে প্রশ্ন করে, উত্তর দেয়।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা: সাহসিকতা ও শিক্ষা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে লড়ছে মেয়েরা।
“আমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া” সুমাইয়ার প্রত্যয়
বর্তমানে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সুমাইয়া প্রতিদিন স্কুলে যায়, প্রজেক্টে অংশ নেয়, বন্ধুদের সঙ্গে দলগত কাজ করে। সে জানায়, “আগে ভাবতাম আমার জীবনও অন্যদের মতো হবে কম বয়সে বিয়ে। এখন ভাবি আমি ডাক্তার হব, মায়ের চিকিৎসা করব।”এই পরিবর্তন কেবল এক কিশোরীর নয়, বরং একটি জাতির। যেখানে শিক্ষা মানে এখন শুধু পাস নয়, বরং জীবন গঠন।২০২৫ সালের নতুন শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে সুমাইয়ার মতো বহু কিশোরী বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরছে শিক্ষার আলোয়। এ কেবল একটি গল্প নয়, বরং একটি চলমান বিপ্লবের প্রমাণ। যেখানে একজন শিক্ষার্থীই হয়ে উঠতে পারে নিজের ভাগ্য নির্মাতা, সমাজ বদলের অগ্রদূত।