ফিলিস্তিনপন্থী সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীরা অভিযোগ তুলেছেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে মাইক্রোসফট, যা গণহত্যাকে ত্বরান্বিত করেছে।
প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০২৫, ৪:২৩:৪৩
উন্মোচন করলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত, রিপোর্টে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম, অভিযোগ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের
অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ এক বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে বহু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের অব্যাহত দখলদারত্ব ও গাজায় গণহত্যায় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। এইসব কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হবে আগামী বৃহস্পতিবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে। এতে নাম উঠে এসেছে ৪৮টি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ইনকরপোরেটেড (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান), অ্যামাজন, আইবিএম এবং সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক লকহিড মার্টিন।
"গণহত্যাও এখন লাভজনক"
প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি দখল এখন অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য লাভজনক 'পরীক্ষাগার' হয়ে উঠেছে। সেখানে চাহিদা আছে, নজরদারির অভাব আছে তাই জবাবদিহিতাও নেই।আলবানিজ বলেন,
“এই দখলদারত্ব এবং এর ফলশ্রুতিতে চলমান গণহত্যা অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য এখন মুনাফার উৎস হয়ে উঠেছে।”
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও ১,৬০০ প্রতিষ্ঠান
ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অন্তত আটটি দেশের ১,৬০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন। এতে সহায়তাকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইতালির লিওনার্দো এসপিএ এবং জাপানের FANUC করপোরেশন।
প্রযুক্তি-আধিপত্য: ক্লাউড, AI ও নজরদারি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ও ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিয়েছে সরকারি পর্যায়ে। এগুলো ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা মজবুত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইবিএম ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং পরিচালনা করছে জনসংখ্যা ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের (PIBA) বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ।
এআই দিয়ে হত্যা টার্গেট: 'ল্যাভেন্ডার', 'গোসপেল', 'হোয়্যার ইজ ড্যাডি'
যুক্তরাষ্ট্রের পালানটিয়ার টেকনোলজিস গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে পালানটিয়ার "স্বয়ংক্রিয় পূর্বাভাসভিত্তিক পুলিশি প্রযুক্তি" ইসরায়েলি সেনাদেরকে AI-এর মাধ্যমে হত্যার টার্গেট তালিকা দিতে সাহায্য করছে। বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু যুদ্ধ উপযোগী পণ্য! বিভিন্ন বেসামরিক প্রতিষ্ঠানও সরাসরি দখলদারত্বে ভূমিকা রাখছে। যেমন ক্যাটারপিলার, ভলভো, রাডা ইলেকট্রনিকস ও হুন্দাই। এদের সরবরাহকৃত ভারী যন্ত্রপাতি ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস ও পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুকিং ডট কম ও এয়ারবিএনবি অবৈধ বসতিতে ঘরবাড়ি তালিকাভুক্ত করে দখলদারত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ থেকে খাবার সবকিছুতে ফিলিস্তিন দমন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লা সরবরাহ করছে ড্রামন্ড কোম্পানি ও গ্লেনকোর। কৃষিখাতে চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইসরায়েলি সংস্থা নুভার মাধ্যমে অবৈধ বসতিতে খাদ্য সরবরাহ করছে।
বিনিয়োগকারীদের লাভের উৎস ফিলিস্তিনের মৃত্যু!
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ড তালিকাভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ব্ল্যাকরকের মালিকানা রয়েছে মাইক্রোসফট (৭.৮%), অ্যামাজন (৬.৬%), আইবিএম (৮.৬%) ও লকহিড মার্টিন (৭.২%) সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে। একইভাবে ভ্যানগার্ডও মালিকানা রাখে ক্যাটারপিলার, পালানটিয়ার ও এলবিট সিস্টেমস–এ।
“এই দখল, এই গণহত্যা একটি করপোরেট পুঁজিবাদের উন্মোচন”
প্রতিবেদনে ইসরায়েলের দখলদারত্বকে অভিহিত করা হয়েছে “ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ” হিসেবে। এতে বলা হয়েছে, এই করপোরেট অর্থনীতিই দখল ও হত্যার মূল চালিকাশক্তি। ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ২০২৩-২৪ সালে ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলারে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারমূল্য বেড়েছে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত।
আইনের আওতায় করপোরেট জায়ান্টরা? জাতিসংঘের প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান সরাসরি বা তাদের পণ্যের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত হলে, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারে। এমনকি উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে তলব করা হতে পারে।
"ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও অপরাধের অংশ"
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এক মতামতে বলেছেন, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দখল যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা উচিত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ইসরায়েলকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দখল শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন সময় এসেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার। রাষ্ট্রগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক থেকে সরে আসতে হবে না হলে, ইতিহাসে তারা অপরাধের সহচর হিসেবেই বিবেচিত হবে।
উপসংহার: এই প্রতিবেদন শুধু একটি নথি নয়, বরং মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও বিশ্বজনমতকে নাড়া দেওয়ার ডাক। প্রশ্ন উঠেছে মুনাফা বড়, নাকি মানবতা?