ইতিহাসের পাতায় আফ্রিকার প্রতিনিধিত্বকারী দেশ সেনেগাল
প্রকাশিত : ০২ জুন ২০২৫, ১২:৩৯:৩৯
দৃঢ়তা, সংযম ও চূড়ান্ত সময়ের বিস্ফোরণ
প্রথম থেকেই সেনেগালের খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলেন গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আর্জেন্টিনার স্টার-স্টাডেড মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগের সামনে সেনেগালের রক্ষণভাগ ছিল সুচারু পরিকল্পনায় গড়া। ম্যাচের ১৫তম মিনিটে ডান দিক থেকে কাতার লিগে খেলা উইঙ্গার ইসমাইলা সার দুর্দান্ত গতিতে ড্রিবল করে গোলপোস্টের বাঁ দিক দিয়ে বল পাঠান জালে।ম্যাচে সমতা আসে দ্বিতীয়ার্ধের ৬৭তম মিনিটে, লিওনেল মেসির একটি ফ্রি কিক থেকে। গোলপোস্টের একেবারে কর্নারে বল বসিয়ে দেন তিনি, যা এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কারিগরি নিখুঁত গোলগুলোর একটি হিসেবে ধরা হচ্ছে।তবে নাটকের শেষ তখনও হয়নি। ৮৬তম মিনিটে কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেড করে গোল করেন তরুণ স্ট্রাইকার নিকোলাস জ্যাকব, যিনি ২১ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বকাপ খেলছেন। গোল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামজুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, আর সেনেগালের বেঞ্চে ফেটে পড়ে উল্লাস।
কৌশল ও নেতৃত্বের জয়
সেনেগাল কোচ আলিউ সিসে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা জানি মেসি ও তাঁর দল কতটা বিপজ্জনক। তাই আমরা কৌশলকে রেখেছি বাস্তবমুখী। কাউন্টার অ্যাটাকে ঝুঁকি না নিয়ে, রক্ষণভাগে চাপ বজায় রেখে খেলার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের ছেলেরা সেটি নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করেছে।” বিশ্বকাপের এই জয় সিসের জন্যও ব্যক্তিগত বড় অর্জন। ২০০২ সালে খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ফ্রান্সকে হারিয়েছিলেন, আর এখন কোচ হিসেবে হারালেন আর্জেন্টিনাকে।
বিশ্বমঞ্চে আফ্রিকার রোল মডেল
সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার এই জয়ের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই জয় কেবল সেনেগালের নয়, এটি আফ্রিকার। যে মানসিকতা, কাঠামো, এবং পরিকল্পনার ছাপ সেনেগাল দেখিয়েছে, তা আফ্রিকান ফুটবলের ভবিষ্যৎ গঠনে মাইলফলক হয়ে থাকবে।” বিশ্বকাপে বহুবার আফ্রিকার দলগুলো নিজেদের প্রতিভা দেখালেও ধারাবাহিকতার অভাবে পিছিয়ে পড়েছে। এই জয়ে তা ভাঙার ইঙ্গিত পরিষ্কার।
মেসির প্রতিক্রিয়া: “এই হার মেনে নেওয়া কঠিন”
ম্যাচ শেষে মেসি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সেনেগাল যেভাবে খেলেছে, সেটি প্রশংসার দাবিদার। আমরা আমাদের সেরা খেলাটা উপস্থাপন করতে পারিনি। এই হার মেনে নেওয়া সহজ নয়, তবে আমাদের সামনে আরও সুযোগ আছে ঘুরে দাঁড়ানোর।” তারকাখচিত আর্জেন্টিনা দল এত সহজে হার মেনে নেওয়ার দল নয়। তবে এই হার ভবিষ্যতের জন্য বড় এক সতর্কবার্তা।
নতুন ট্রেন্ডের জন্ম
ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসে হাজারো প্রতিক্রিয়া। #SENvsARG #AfricanPower #MessiDefeated #LionRoars হ্যাশট্যাগগুলো ছড়িয়ে পড়ে টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে।বিশ্বব্যাপী ফুটবলপ্রেমীরা সেনেগালের খেলোয়াড়দের প্রশংসায় মুখর। আর্জেন্টিনার পরাজয়কে ‘চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো বাস্তবতা’ হিসেবে অভিহিত করছেন অনেক ক্রীড়া বিশ্লেষক।
কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে?
এই জয়ের মাধ্যমে সেনেগাল গ্রুপ-এইচ এর শীর্ষে উঠে এসেছে। পরবর্তী ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ পোল্যান্ড, যারা দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-২ গোলে পরাজিত করেছে। এই ম্যাচ জিতলে সেনেগালের জন্য দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে যাবে।অন্যদিকে আর্জেন্টিনার জন্য বাকি দুটি ম্যাচ এখন বাঁচা-মরার লড়াই। কোচ লিওনেল স্কালোনির কৌশল ও খেলোয়াড় নির্বাচনে পরিবর্তন আনতেই হবে।
এক জয়ের অনেক অর্থ
সাবেক ফরাসি কোচ রেমন্ড ডোমেনেক বলেন, “সেনেগালের এই জয় বিশ্বকাপে একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমা ভেঙে দিয়েছে। বিশ্ব ফুটবলে শক্তির ভারসাম্য পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বাইরে থেকে যেসব দল উঠে আসছে, তাদের ভবিষ্যৎ এখন আর কল্পনা নয় বাস্তব।”
বিশ্বকাপ ২০২৫ কি আফ্রিকার নতুন ইতিহাস রচনা করবে?
সেনেগালের এই জয় হয়তো একটি ম্যাচ, কিন্তু এর প্রতিধ্বনি বহু দূর যাবে। বিশ্ব ফুটবল এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যেখানে ফিফার র্যাঙ্কিং কিংবা ঐতিহ্য আর জয় নিশ্চিত করে না। সেখানে সাহস, পরিকল্পনা ও স্নায়ু নিয়ন্ত্রণই বড় সম্পদ।বিশ্বকাপ ২০২৫ এখন আর শুধুমাত্র ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিযোগিতা নয় এটি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। সেনেগাল দেখিয়ে দিয়েছে, আফ্রিকাও প্রস্তুত, এবং তারা শুধুমাত্র অংশগ্রহণকারীর ভূমিকায় নয় নেতৃত্ব দিতে এসেছে।