ন্যায়বিচারের পরিমাপ কি রক্তের বদলে রক্ত, নাকি সংশোধনের সুযোগ?
প্রকাশিত : ২৯ মে ২০২৫, ১:৫৯:৪৮
ন্যায়বিচারের পরিমাপ কি রক্তের বদলে রক্ত, নাকি সংশোধনের সুযোগ?
ঘটনার পটভূমি: একই অপরাধ, ভিন্ন রায়
গত এক দশকে বাংলাদেশে আলোচিত বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের রায়ে দেখা গেছে বিচিত্রতা কিছু মামলায় মৃত্যুদণ্ড, আবার কিছুতে যাবজ্জীবন। যেমন, ২০১২ সালের তানিয়া ধর্ষণ-হত্যা মামলায় প্রধান আসামির ফাঁসি হলেও, একই প্রকৃতির আরেকটি মামলায় অভিযুক্তদের দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এই দ্বৈততা সমাজে প্রশ্ন তোলে কোন রায় প্রকৃত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে? মৃত্যুদণ্ড না আজীবন কারাবাস?
আইনি কাঠামো: কোন অপরাধে কোন সাজা
বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো গুরুতর অপরাধে শাস্তি নির্ধারণ হয়:
- দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুযায়ী "যে কেউ হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যাবে।"
- শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড নয়, সংশোধনমূলক ব্যবস্থা।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধে শাস্তির সীমা নির্দিষ্ট থাকলেও বিচারকের বিচারবোধ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইনের ভাষা সুযোগ রাখে, কিন্তু প্রশ্ন বিচারকের মনোভাব কীভাবে এই ‘দুই রাস্তা’র একটিকে বেছে নেয়?
আদালতের পর্যবেক্ষণ: ‘প্রতিকার নাকি প্রতিশোধ’?
হাইকোর্টের একটি আলোচিত রায়ে বলা হয়:“মৃত্যুদণ্ড কোনো সমাজকে নিরাপদ করে না, বরং আইনি নির্ভরতায় মানুষ নিরাপত্তা অনুভব করে।”
তবে সুপ্রিম কোর্টের আরেক মামলায় বলা হয়:“যে অপরাধ সমাজকে স্তম্ভিত করে দেয়, সেখানে শাস্তি হওয়া উচিত সর্বোচ্চ।” এই দ্বিমত সমাজে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে ন্যায়বিচার কি প্রতিশোধের প্রতীক, নাকি মানুষের সংশোধনের সুযোগ?
আইনজীবী ও বিচারকদের মতামত
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ রাশেদ বলেন:“ফাঁসি মানে ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত রূপ নয়। আমাদের বিচারব্যবস্থা এখন ধীরে ধীরে সংশোধনমূলক শাস্তির দিকে এগোচ্ছে।”
অন্যদিকে বিচারপতি (অব.) আবদুল মতিন বলেন:“যেখানে অপরাধ প্রমাণিত হয় ভয়াবহতা ও পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে, সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তিই অপরাধপ্রতিরোধে কার্যকর।”
বাস্তব কেস স্টাডি: দুই রায়ের তুলনা
১. রিফাত শরীফ হত্যা মামলা (বরগুনা)
ভিডিও ফুটেজ, পরিকল্পনা, ও নির্মমতা এসব প্রমাণের ভিত্তিতে প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ডের
সহযোগীদের একাংশের ফাঁসি হয়, অপরাংশের যাবজ্জীবন।
প্রতিক্রিয়া: সাধারণ মানুষের অংশ বলেছে "নয়ন বেঁচে থাকলে হয়তো আরও কিছু জানতাম।"
২. সালাউদ্দিন হত্যা মামলা (ঢাকা)
ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন হত্যায় বিচারক বলেন, “অভিযুক্ত তরুণদের সংশোধনের সুযোগ প্রয়োজন।” রায় যাবজ্জীবন।
মনোবিজ্ঞানী বিশ্লেষণ: ভয় না উপলব্ধি?
ড. নওরীন জামান (মনোবিজ্ঞানী):
“মৃত্যুদণ্ড তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, কিন্তু যাবজ্জীবন একটি দীর্ঘ উপলব্ধির প্রক্রিয়া। সমাজে অপরাধ দমন তখনই হয়, যখন অপরাধী অনুতপ্ত হয় না যে সে লাশে পরিণত হয়।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া: বিভক্ত দৃষ্টিভঙ্গি
- অনেকে মনে করেন, "ফাঁসি না দিলে অপরাধ বাড়বে।"
- অন্যপক্ষ বলে, "মৃত্যুদণ্ড মানে ভুলের সংশোধনের পথ বন্ধ।"
ন্যায়বিচার মানে কী শেষ কথা, না শেষ সুযোগ?
আইন যদি হয় মানবতার প্রতিফলন, তবে মৃত্যুদণ্ড কি সেই মানবতার সমাপ্তি?
ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ নিশ্চিত করা। তাই ‘ফাঁসি বনাম যাবজ্জীবন’ বিতর্কে আমরা ভুলে যাই মূল প্রশ্ন হলো, অপরাধী কী বুঝেছে তার ভুল? সমাজ কী পেল অপরাধের বিচার থেকে? ন্যায়বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়, বরং অপরাধের উৎসে আঘাত হানা এবং ভবিষ্যতের অপরাধ প্রতিরোধে বার্তা দেওয়া।