নথিপত্রে 'সত্য', কিন্তু সমাজে কতটা প্রতিফলিত হয় ন্যায়?
প্রকাশিত : ২৯ মে ২০২৫, ১:৪৯:৪৮
নথিপত্রে 'সত্য', কিন্তু সমাজে কতটা প্রতিফলিত হয় ন্যায়?
মামলার পটভূমি ও আইনি কাঠামো:একটি খুনের মামলার বিচারপ্রক্রিয়া মানে শুধুমাত্র দোষী সাব্যস্ত নয় এটি একটি দীর্ঘ পথ, যেখানে তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইনি যুক্তি এবং বিচারিক বিবেচনা সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশে খুনের মামলায় সাধারণত ফৌজদারি দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হয়, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে কখনো শিশু আইন ২০১৩ বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ীও বিচার হয়, যদি ভুক্তভোগী নারী বা শিশু হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো তদন্তের তথ্য, সাক্ষ্য আর বাস্তবতা কি সবসময় এক জায়গায় দাঁড়ায়?
আদালতের পর্যবেক্ষণ: চলমান বিচারিক ব্যবস্থায় দেখা যায়, বহু মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন ও বিচারিক রায় পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।
ঢাকার একটি আলোচিত খুনের মামলায় বিচারক রায়ে বলেন "তদন্তে ঘাটতি এবং ভুল সাক্ষ্য উপস্থাপন ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সত্য উন্মোচনে তদন্ত কর্মকর্তার আন্তরিকতা অপরিহার্য।" বিচারক আবু সালেহ মো. কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ
এমন পর্যবেক্ষণ প্রায়ই উঠে আসে, বিশেষ করে যখন মামলা হয় রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতায়।
তদন্ত কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি: একটি স্বচ্ছ তদন্ত করতে গেলে মাঠ পর্যায়ে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, তা স্বীকার করেছেন একজন অভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তা: "অভিযোগপত্রে প্রভাব, সাক্ষীর ভয়, প্রমাণ লোপাট—এই চাপে তদন্ত অনেক সময় আদর্শমুখী থাকতে পারে না।" পরিদর্শক সোহেল রানা, সিআইডি
এমন স্বীকারোক্তি ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললেও বাস্তবতা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।
বাস্তব কেস স্টাডি: সাগর-রুনি হত্যা মামলা
২০১২ সালের আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের এখনো কোনো চূড়ান্ত বিচার হয়নি। তদন্ত একাধিক সংস্থার হাতে ঘুরেছে র্যাব, পিবিআই, সিআইডি কিন্তু এখনো পর্যন্ত চার্জশিট দাখিল হয়নি।
এই ঘটনা আইনি ব্যর্থতা, তদন্ত জটিলতা এবং বিচারহীনতার প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে।
মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে তদন্তবিভ্রান্তি:
মনোবিজ্ঞানী ডা. রেশমা কবির বলেন "দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার বিলম্ব মানুষের মধ্যে আইন ও ন্যায়ের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে। এতে সামাজিক সহিংসতা ও প্রতিশোধ প্রবণতাও বাড়ে।"এমন মানসিক প্রভাব সমাজকে আরও উত্তপ্ত ও অনিশ্চিত করে তোলে।
আইনজীবীর মতামত:সিনিয়র অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার কাইয়ুম বলেন "তদন্তব্যবস্থায় প্রযুক্তি, স্বাধীনতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে কোনো রায়ই নিঃসংশয়ে 'ন্যায়বিচার' বলা যায় না।"
তিনি আরও বলেন, আদালত অনেক সময় তদন্ত ভুলের কারণে নির্দোষকে দোষী বা দোষীকে নির্দোষ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
উপসংহার: বিচার মানেই কি সত্যের বিজয়?
খুনের মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্ত যদি হয় পক্ষপাতদুষ্ট, তবে আদালতের রায় সত্যকে তুলে ধরতে পারে না।
ন্যায়বিচার তখন হয়ে দাঁড়ায় শুধুই আইনি ভাষ্য not the social truth.
আদালত যতই চেষ্টায় থাকুক, যদি প্রাথমিক তদন্তে দুর্বলতা থাকে, তবে সমাজের কাছে ন্যায়বিচারকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা কঠিন।এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীন, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তব্যবস্থা ছাড়া কোনো রায়ই দীর্ঘমেয়াদে সমাজে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে না।
- খুনের মামলার তদন্তে বাস্তবতা কতটা প্রতিফলিত হয়?
- ফৌজদারি আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা
- আদালতের রায় বনাম তদন্ত রিপোর্ট: কোথায় ব্যবধান?
- সাগর-রুনি হত্যার বিচারহীনতা: একটি ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি
- বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কতটা বাস্তবসম্মত?