দীর্ঘ চাপের পর অর্থনীতিতে ফিরছে স্থিতিশীলতা মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে এসেছে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি।
প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০২৫, ১১:০৯:১৬
২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’ দেশের অর্থনীতিকে স্থবিরতা থেকে গতি ফিরিয়ে আনতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রায় এক বছর সময় পেরিয়ে এসেছে, আর এ সময়ে অর্থনীতির নানা সূচকে ধরা দিয়েছে ইতিবাচক অগ্রগতি। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা এ অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, গত দশকে যেসব সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছিল, যেমন- রিজার্ভ সংকট, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, রাজস্ব ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি তা সামলানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বড় পুনরুদ্ধার, রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড, রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এসবের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির ভিত কিছুটা হলেও মজবুত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মূল্যস্ফীতি গত প্রায় তিন বছরের মধ্যে সব চেয়ে নিচে নেমেছে। তবে বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে এখনও উদ্বেগ কাটেনি।
২০২৪ সালের জুনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। তবে জুলাই আন্দোলনের পর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রেমিট্যান্স প্রণোদনা হার ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করা এবং হুন্ডি প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর অভিযান। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড গড়ে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১.৬৮ বিলিয়ন ডলারে। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩০.২১ বিলিয়ন ডলার, যা এক অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এলসি নিষ্পত্তি হচ্ছে ১২৩-১২৪ টাকা হারে, আর ব্যাংকগুলো এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনছে ১২২.৭০ টাকায়। আমদানি খাতে চাপ কম থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বড় অবদান এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩৯.৩৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাত থেকে আয় ২১.১৬ বিলিয়ন এবং ওভেন পোশাক থেকে ১৮.১৮ বিলিয়ন ডলার।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৩৯ শতাংশে এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯.৩৭ শতাংশ। সরকার আমদানি শুল্কে ছাড়, টিসিবি কার্যক্রম জোরদার এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর ব্যবস্থাকে সহজ ও স্বচ্ছ করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন 'a-Chalan', ই-রিটার্ন, VOSS এবং ASYCUDA World চালু করেছে। এ ছাড়াও এনবিআরের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের কার্যক্রম মনিটর করা সম্ভব হচ্ছে।
নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে পাঁচটি প্রধান সংস্কার চালু হয়েছে: দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ, অর্থপাচার তদন্ত, একক বিনিময় হার, শাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, এবং আইনি কাঠামো সংস্কার। তবে এখনও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে, ঋণখেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ব্যাংকিং সংকটে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সরকার নতুন দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করেছে এবং উদ্যোক্তা সহায়তায় 'ইনভেস্টমেন্ট উইন্ডো' চালু করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রণোদনা প্যাকেজ পুনর্মূল্যায়ন চলছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না।
জুলাই আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তবে এ অগ্রগতিকে টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ জরুরি।