জলবায়ু রক্ষার নামে শুরু হয়েছে নতুন ধরনের বৈশ্বিক বাজার ‘কার্বন
প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২৫, ৪:২১:২২
জলবায়ু রক্ষার নামে শুরু হয়েছে নতুন ধরনের বৈশ্বিক বাজার ‘কার্বন ট্রেডিং’। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এটি কি ন্যায়ের পথে যাচ্ছে, নাকি ধনী দেশগুলোর দায় গরিবদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
কার্বন ট্রেডিং কী?
‘Carbon Trading’ হলো একটি বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থা, যেখানে কার্বন নিঃসরণের জন্য নির্ধারিত সীমা দেওয়া হয় এবং যে দেশ বা প্রতিষ্ঠান কম নিঃসরণ করে, তারা অতিরিক্ত ‘কার্বন ক্রেডিট’ বিক্রি করতে পারে। অপরদিকে, যারা বেশি নিঃসরণ করছে, তারা এই কার্বন ক্রেডিট কিনে নিজের ‘নেট নিঃসরণ’ শূন্য দেখাতে পারে। এ ব্যবস্থার মূল ধারণা বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখা, কিন্তু বাস্তবায়নের ধরণ নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক।
কার্বন ট্রেডিংয়ের বৈশ্বিক চিত্র
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন বাজার চালু করেছে EU Emissions Trading System (EU ETS)।
- চীন ২০২১ সালে তার নিজস্ব জাতীয় কার্বন মার্কেট চালু করেছে, যা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম।
- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও কানাডা ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক কার্বন বাজার গঠন করেছে।
- ভারত ও ব্রাজিল স্বেচ্ছাসেবী কার্বন মার্কেট সম্প্রসারণে কাজ করছে।
গরিব দেশগুলোর অবস্থান কোথায়?
উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো (LDCs), যেমন বাংলাদেশ, নেপাল, সিয়েরা লিওন, এসব দেশ জলবায়ু নীতির আওতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ‘কার্বন ক্রেডিট’ অর্জনের ক্ষমতা রাখে বন সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প, ও টেকসই কৃষিপদ্ধতির মাধ্যমে।
কিন্তু সমস্যা হলো
কার্বন ক্রেডিট তৈরি ও বিক্রির জন্য প্রয়োজন জটিল কারিগরি মূল্যায়ন ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা।
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশ এ বিষয়ে দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় পিছিয়ে।
ফলস্বরূপ, ধনী দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোই বড় মুনাফা করছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা
বাংলাদেশ এখনো পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কার্বন বাজার গঠন করেনি, তবে:
- গ্রিন ফ্যাক্টরি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প থেকে কার্বন ক্রেডিট রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
- সুন্দরবন ও পাহাড়ি বনাঞ্চল সংরক্ষণ প্রকল্পগুলোও আন্তর্জাতিক কার্বন অফসেট মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
- ২০২৩ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (BCCT) থেকে এই খাতের জন্য নীতিমালার খসড়া তৈরি হয়েছে।
তবে এখনো পর্যন্ত বেসরকারি খাতে এই বাজারের প্রবেশ বা বিনিয়োগ খুবই সীমিত। ড. রুবাইয়াৎ ফিরোজ, পরিবেশ ও জলবায়ু নীতি বিশ্লেষক, বলেন “কার্বন ট্রেডিং ধারণাটি ইতিবাচক, তবে বাস্তবে এটি ধনী দেশের জন্য নিঃসরণ ‘কিনে নেওয়ার’ সুযোগ তৈরি করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রকৃতি রক্ষা করেও অর্থ পাচ্ছে না, বরং ঝুঁকি কাঁধে নিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের উচিত জাতীয়ভাবে কার্বন অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম গড়ে তুলে বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করা।”
কার্বন ট্রেডিং কি জলবায়ু ন্যায়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছে?
সমালোচকদের মতে, ধনী দেশগুলোর শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন টাকা দিয়ে দায়মুক্তি পায় এবং গরিব দেশগুলো বন রক্ষা করেও পর্যাপ্ত সহায়তা পায় না, তখন এটি একটি "জলবায়ু-সাম্রাজ্যবাদী" কাঠামোর জন্ম দেয়।
বিশেষ করে:
- ধনী দেশসমূহ নিজেদের কার্বন নিঃসরণ ‘অফসেট’ করছে কিন্তু কার্বন হ্রাস করছে না।
- দরিদ্র দেশগুলোকে রক্ষা করতে হচ্ছে বনভূমি, কিন্তু জাতীয় উন্নয়নের জন্য সেসব ভূমি ব্যবহার করতে পারছে না।
- স্থানীয় জনগোষ্ঠী বন রক্ষার দায়িত্বে থাকলেও তারা পাচ্ছে না পর্যাপ্ত প্রণোদনা।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
- জাতীয় পর্যায়ে স্বচ্ছ ও মানসম্মত কার্বন রেজিস্ট্রি গঠন
- বেসরকারি খাতে কার্বন ক্রেডিট উৎপাদনে সহায়তা ও উদ্ভাবনী তহবিল
- স্থানীয় জনগণের মালিকানাভিত্তিক বন সংরক্ষণ প্রকল্প চালু
- আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারে প্রবেশে কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো