প্রকাশিত : ০২ জুন ২০২৫, ১:১০:৪৮
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণে এখনও স্থায়ী কোনো পেশাদার কাঠামো গড়ে ওঠেনি এই অভিযোগ বহু পুরোনো। কিন্তু নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিষয়টি, যখন এক তরুণ পরিচালক তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “আমার সিনেমা বন্ধ করে দিল তারা।”২০২৫ সালের শুরুর দিকে শুটিং শুরু হওয়া ‘তিনতলার গল্প’ নামের একটি স্বাধীন প্রযোজনার চলচ্চিত্র ইতিমধ্যে ১২ দিনের চিত্রধারণ শেষ করেছিল। অথচ মাঝপথেই প্রযোজক বিনিয়োগ বন্ধ করেন এবং ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সিনেমাটি গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। নির্মাতা জানান, কোনো লিখিত নোটিশ ছাড়া তাঁকে জানানো হয়, “সিনেমাটি আর নির্মিত হচ্ছে না।”
অনুদান নয়, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি হওয়া প্রজেক্ট: ‘তিনতলার গল্প’ কোনও সরকারি অনুদানের সিনেমা নয়। এটি নির্মিত হচ্ছিল পরিচালক ইমতিয়াজ জাহিদ ও তার দলীয় অর্থায়নে। সিনেমার বিষয়বস্তু ছিল শহরের ভেতরে বাস করা একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তব জীবনসংগ্রাম নিয়ে। এর আগে তিনি একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে নির্বাচিত হয়েছিল। এই সিনেমাটি তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র। এতে অভিনয় করছিলেন থিয়েটারভিত্তিক কিছু শিল্পী ও একাধিক নবাগত মুখ। শুটিং শেষ হওয়ার কথা ছিল মে মাসের মধ্যে। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎই প্রযোজক ‘বাজেট সংকট’, ‘বাজার সম্ভাবনা না থাকা’ এবং ‘ওটিটি গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা’ ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে নির্মাণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন।
ঢালিউডে বারবার এমন ঘটনা কেন ঘটে?: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে নির্মাণ স্থগিত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ‘চাবি’, ‘নকশীকাঁথা’, ‘বিল্ডিং নম্বর ৪১’ এরকম অসংখ্য সিনেমার কাজ মাঝপথে থেমে গেছে বাজেট, বিতরণ, সেন্সর বা প্রযোজক-পরিচালকের দ্বন্দ্বে। ঢালিউডে এখনো ফিল্ম ইনস্যুরেন্স, স্টুডিও-ভিত্তিক চুক্তি, অথবা ক্রিয়েটিভ কনট্রাক্ট কালচার গড়ে ওঠেনি। এর ফলে পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া হয়ে পড়ে ব্যক্তিনির্ভর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি শুটিং শুরুর পর সেটি নির্মিত না হওয়ার মানে শুধু একটি সিনেমার থেমে যাওয়া নয় এর অর্থ একদল টেকনিশিয়ান, অভিনেতা, নির্মাতার কয়েক মাসের পরিশ্রম এবং স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
বিতরণব্যবস্থা ও ওটিটি গ্রহণযোগ্যতার সংকট: বর্তমানে নতুন নির্মাতারা সিনেমা তৈরি করলেও সেটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। একদিকে হলের সংকট, অন্যদিকে বড় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু তারকাভিত্তিক বা বিদেশি ছবিতে আগ্রহ দেখায়। ফলে বিতরণ সংস্থাগুলো এ ধরনের ছোট বাজেটের কনটেন্ট নিতে চায় না। নির্মাতারা পড়েন একপ্রকার অচলাবস্থায় ছবি বানিয়েও দেখানোর সুযোগ মেলে না। যেখানে ভারত, নেপাল বা শ্রীলঙ্কাতেও স্বাধীন চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা উৎসব, ফান্ডিং ও চ্যানেল রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে এখনো সেই ন্যূনতম কাঠামো অনুপস্থিত।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বনাম শিল্পের অসম্মান: বর্তমানে হালকা ক্যামেরা, ফ্লেক্সিবল ইউনিট ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগ দিয়ে সিনেমা নির্মাণ সম্ভব হলেও, প্রযোজক ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা না থাকলে, সেটি কোনও পেশাদার কাঠামো তৈরি করে না। একজন নির্মাতা যখন ঘোষণা ছাড়াই জানেন, তাঁর প্রজেক্ট বাতিল, তখন শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি নয় মনস্তাত্ত্বিকভাবে একধরনের সাংস্কৃতিক অপমানও তৈরি হয়।
সিনেমা নির্মাণ যেন লটারি না হয়: বাংলাদেশে অনেক তরুণ নির্মাতা সাহস করে ক্যারিয়ারের শুরুতেই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে আসেন। কিন্তু তারা দেখতে পান যে শিল্পটি তাদের ভেতর থেকে গড়ে তোলে, সেই শিল্পে নেই ন্যূনতম স্থায়িত্ব বা সুরক্ষা। সিনেমা যেন আর একক নির্ভরতা না হয় এখন সময় এসেছে পেশাদার প্রোডাকশন কাঠামো, ইনস্যুরেন্স সিস্টেম ও নির্মাতাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার। অন্যথায় ‘আমার সিনেমা বন্ধ করে দিল তারা’ এমন হৃদয়বিদারক বাক্য আরও বহুবার শোনা যাবে।