ব্র্যাক ও ইউএনডিপি’র গবেষণায় প্রমাণিত উপবৃত্তি কার্যকরভাবে পৌঁছাল
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১২:৫৯:২৫
ব্র্যাক ও ইউএনডিপি’র গবেষণায় প্রমাণিত উপবৃত্তি কার্যকরভাবে পৌঁছালে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও ফলাফল দুই-ই বাড়ে
ঢাকা | মে ২০২৫
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চরাঞ্চলের মেয়ে শিউলি আক্তার। কখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি। তার ছোট বোন মিমের ভাগ্যে সে সুযোগ এসেছে কারণ এবার পরিবারটি উপবৃত্তি পাচ্ছে। মিম এখন নিয়মিত স্কুলে যায়, তার মা বলে, “ওর জন্য মাসে একশ টাকা আসতেছে মোবাইলে। বই কিনতে পারছি, ইউনিফর্ম বানাইছি। আগে মনে হতো স্কুলে পাঠানো মানে খরচ, এখন মনে হয় উপকার।” এ দৃশ্য এখন বাংলাদেশজুড়েই নানা প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। গবেষণা বলছে শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, উপবৃত্তি শিশুদের স্কুলে ধরে রাখার অন্যতম কার্যকর উপায়।
ব্র্যাক-ইউএনডিপি গবেষণা: কী বলছে তথ্য?
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ও ইউএনডিপি যৌথভাবে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেশের ২৩টি জেলার ৫০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪,০০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। মূল ফলাফলগুলো হলো
নিয়মিত উপবৃত্তি পাওয়া শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির হার: ৮৭%
যাদের উপবৃত্তি অনিয়মিত বা বন্ধ, তাদের উপস্থিতি নেমে আসে ৫৪%-এ
উপবৃত্তি পাওয়া অভিভাবকদের মধ্যে ৭৪% বলেছে “টাকা না পেলে শিশুকে স্কুলে রাখা সম্ভব হতো না”
উপবৃত্তির ফলে বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও উত্তীর্ণের হার বেড়েছে প্রায় ১৩%
গবেষণা দলনেতা ড. শবনম হাসান বলেন, “এই উপবৃত্তি নিছক দান নয়, এটি শিশুদের মধ্যে শৃঙ্খলা, স্কুলে আসার আগ্রহ এবং পরিবারে শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ায়।” চট্টগ্রামের বাঁশখালীর একটি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, “আমাদের স্কুলে উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রায় শতভাগ। যাদের নাম তালিকায় নেই, তারাই সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত।” গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের দিনমজুর সোহেল বলেন “আমার বাচ্চা স্কুলে গেলেই মোবাইলে টাকা আসে। ওই টাকা না পাইলে স্কুলে পাঠানোই হতো না। এখন আমি নিজেই খোঁজ নেই স্কুলে ঠিকমতো যায় কিনা।”
সরকারের বক্তব্য ও পরিসংখ্যান
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপবৃত্তি বাবদ বরাদ্দ ছিল ২,২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি শিশু উপবৃত্তির আওতায় রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার পদ্ধতিতে উপবৃত্তি দেওয়ার ফলে দুর্নীতি কমেছে, স্বচ্ছতা বেড়েছে। এখন প্রমাণ আছে এই টাকা শিশুদের বিদ্যালয়ে আনছে।” তবে তিনি স্বীকার করেন, “কিছু এলাকায় মোবাইল নম্বর বা সিস্টেম আপডেটের অভাবে বিলম্ব হচ্ছে, তা দ্রুত সমাধানে কাজ চলছে।”
অর্থ ছাড়াও যেসব সমস্যায় উপবৃত্তি কার্যকর নয়
তথ্য বলছে, উপবৃত্তি কার্যকর হলেও কিছু বাধা রয়ে গেছে:
- কিছু পরিবার উপবৃত্তির অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করে
- অনেক অভিভাবকই জানেন না কীভাবে তালিকাভুক্ত হতে হয়
- অনিয়মিত উপস্থিতির পরও কিছু এলাকায় উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে
- বিদ্যালয়ে পরিদর্শন ও উপস্থিতি যাচাইয়ের দুর্বলতা
- উপবৃত্তির অর্থ সময়মতো না পৌঁছানো
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যে উপবৃত্তি এবং মিড ডে মিল চালু হওয়ার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি বেড়েছে ২৫%-এর বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার "Child Grant" প্রোগ্রামের গবেষণায় দেখা গেছে অর্থনৈতিক সহায়তা থাকলে প্রান্তিক শিশুরা শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদে সফলতা অর্জন করে। বাংলাদেশেও একই ধরনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে, যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
শিক্ষাবিদদের মতামত: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান বলেন, “শিক্ষা শুধু খাতা-কলমের বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। উপবৃত্তি সেই আন্দোলনের জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে পৌঁছায়।” তিনি আরও বলেন, “শুধু টাকা দিলেই হবে না স্কুলে খাবার, বিনামূল্যে ড্রেস, প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং সেবাও থাকতে হবে।”
সুপারিশ ও করণীয়
1. উপবৃত্তি প্রদানে অভ্যন্তরীণ যাচাই ও উপস্থিতি নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা
2. উপবৃত্তির অর্থ নির্দিষ্ট শিক্ষা উপকরণে ব্যয় নিশ্চিত করতে অভিভাবক প্রশিক্ষণ
3. জেলাভিত্তিক অডিট টিম গঠন ও পাবলিক রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করা
4. স্কুলভিত্তিক মনিটরিং সেল ও ইউনিয়ন শিক্ষা কমিটির সক্রিয়তা নিশ্চিত করা
5. মোবাইল অ্যাপে উপস্থিতি ট্র্যাকিং এবং সরাসরি শিক্ষার্থী যাচাই ব্যবস্থা চালু করা
একটি শিশুর স্কুলে যাওয়া মানে কেবল তার বই পড়া নয়, বরং একটি পরিবার, একটি সমাজ ও একটি দেশের ভবিষ্যতের গড়ে ওঠা। সেই যাত্রায় যদি উপবৃত্তি সত্যিকারের ভূমিকা রাখতে পারে তবে সেটি আর কোনো প্রণোদনা নয়, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিনিয়োগ।