অভাব, অনুপস্থিতি, আর বঞ্চনার চাপে শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়ছে
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১২:৫৩:৩৯
অভাব, অনুপস্থিতি, আর বঞ্চনার চাপে শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়ছে লক্ষ শিশু
গাইবান্ধা ও কক্সবাজার থেকে |
সকাল ৯টা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই, অথচ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতেগোনা। ক্লাস থ্রির ছাত্রী মরিয়ম গত সপ্তাহেই স্কুল ছেড়েছে। তার মা বললেন, “বাবা নাই, আয়ও নাই। দুই বেলার খাবার যোগাড়ই কষ্ট। মেয়ে বড় হচ্ছে, ঘরের কাজ তো করতে হবে।” শুধু মরিয়ম না, ওই অঞ্চলের আরও অনেক শিশুই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। উপবৃত্তির অর্থ সময়মতো না আসা, ইউনিফর্ম বা বই কেনার সামর্থ্য না থাকা, এবং পরিবারে বাড়তি সাহায্যের প্রয়োজন এসব মিলে থেমে যাচ্ছে তাদের স্কুলজীবন।
সরকারি নীতির বাস্তবতা কতটা ফলপ্রসূ?
সংবিধান অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও মাঠপর্যায়ে তার বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (BANBEIS)-এর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৪.২ শতাংশ। ২০২৫-এর শুরুর প্রাথমিক পরিসংখ্যানে সে হার আরও কিছুটা বেড়েছে বলে ধারণা কর্মকর্তাদের। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা UNICEF-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিশুদের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শিশু ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
কক্সবাজারেও একই চিত্র
টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের একটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি শ্রেণির ক্লাসে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা মাত্র ১৮। অথচ ভর্তি খাতায় নাম রয়েছে ৫২ জন শিক্ষার্থীর। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, “বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী মাছ ধরায় যায় কিংবা মাঠে কাজে ব্যস্ত। অনেক অভিভাবক বলছে টাকা পেলে পাঠাবে, না হলে নয়।” একই এলাকার বাসিন্দা শাহেদার ভাষায়, “উপবৃত্তির টাকা আসে না নিয়মিত। বই কিনতে, ড্রেস বানাতে গেলে ৫০০ টাকা লাগে। স্কুলে পাঠাইবো কীভাবে?”
শিক্ষাবিদদের মত: শিক্ষানীতিবিদ ড. জাকারিয়া কবীর বলেন, “শিশুদের স্কুলে রাখতে হলে শুধু উপবৃত্তি নয়, প্রয়োজন একটি সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো। মিড ডে মিল, বিনা খরচে পোশাক, আর নিয়মিত মনিটরিং না থাকলে এই প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “এই সমস্যা শুধু শিক্ষা খাতের নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিফলন।”
সরকারি উদ্যোগ কতটা কার্যকর?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, “২০২৫ সালে আমরা ‘স্কুলে ফিরে যাও’ নামে একটি পুনঃভর্তি ক্যাম্পেইন চালু করেছি। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ঝরে পড়া শিশুদের তালিকা করে তাদের স্কুলে ফেরত আনার চেষ্টা চলছে।” তবে মাঠপর্যায়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, এই উদ্যোগ অনেকাংশেই লোক দেখানো থেকে যাচ্ছে নেই পর্যাপ্ত জনবল, নেই কার্যকর ফলোআপ।
কী করা উচিত?
- উপবৃত্তির অর্থ দ্রুত ও স্বচ্ছ উপায়ে বিতরণ
- মিড ডে মিল কর্মসূচি বাধ্যতামূলক করা
- ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘ঝরে পড়া শিশু পুনর্বাসন কমিটি’ গঠন
- শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ
- মায়েদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কর্মশালা
স্কুলজীবন শুধু একটি পাঠ্যধারা নয়, বরং শিশুর ভবিষ্যতের ভিত। সেই ভিত যদি ছোটবেলায়ই ধ্বসে পড়ে, তাহলে যে জাতি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে তার ভিত্তি থাকবে কতটা মজবুত? শিশুদের স্বপ্ন যেন বড় বাধায় থেমে না যায় এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের।