৬ মাসে ঝরে পড়া ৩০ হাজার শিশু ফেরত এসেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১২:৪১:৪৭
৬ মাসে ঝরে পড়া ৩০ হাজার শিশু ফেরত এসেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি কার্যক্রমের নতুন সাফল্য
কিশোরগঞ্জ ও যশোর থেকে | মে ২০২৫
শুধু ছয় মাস আগে যাদের নাম সরকারি খাতায় “ঝরে পড়া” তালিকায় ছিল, আজ তারা আবার শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত সারা দেশে ৩০,৩৬৮ জন ঝরে পড়া শিশু পুনরায় ভর্তি হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন এই ফেরার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে নতুন ডিজিটাল উপবৃত্তি কার্যক্রম এবং মাঠপর্যায়ে বাড়তি মনিটরিং। তারা একে বলছেন, “উপবৃত্তির জাদু।”
ঘটনাস্থলে দেখা গেল যা
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের তালিকায় অনেক পরিচিত নাম। তৃতীয় শ্রেণির হাসান এক বছর আগে কৃষিকাজে নেমেছিল। আজ সে আবার ক্লাসে বসে বাংলা পড়ছে। তার মা, নাসিমা বেগম বলেন, “আগে স্কুলে পাঠাইতাম, কিন্তু উপবৃত্তির টাকা বন্ধ ছিল। এখন নিয়মিত পাচ্ছি। ওর খাতা, পেন্সিল সব কিনে দিতে পারতেছি। তাই ওকে আবার ভর্তি করাইছি।”
পরিসংখ্যান যা বলছে
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী:
- ডিসেম্বর ২০২৪-এ দেশে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখের বেশি
- নতুন কার্যকরী ফলোআপ এবং উপবৃত্তি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে মে ২০২৫-এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি শিশু স্কুলে ফিরেছে
- সবচেয়ে বেশি শিশু ফেরত এসেছে কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, যশোর, পটুয়াখালী ও সুনামগঞ্জে
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬১% ছিল ছেলেশিশু এবং ৩৯% মেয়ে
উপবৃত্তি পেলেই কেন ফিরে আসে?
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির একজন প্রোগ্রাম ম্যানেজার বলেন, “উপবৃত্তি শিশুর হাতে টাকা না দিয়ে মা-বাবার মোবাইলে দেওয়ায় এখন তারা পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহ পাচ্ছে। প্রতিমাসে মোবাইলে বার্তা আসছে ‘আপনার সন্তান স্কুলে গেলে টাকা পাবেন।’ এটি দারুণ কাজ করছে।” সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার এক অভিভাবক বলেন, “ছেলেটা কাজে যাইত, এখন বলে, ‘স্কুলে না গেলে তো টাকা আসবে না।’ এতেই তো উৎসাহ।”
সরকারের বক্তব্য: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা এই ৩০ হাজার শিশুর প্রত্যাবর্তনকে বড় অর্জন হিসেবে দেখছি। প্রতিটি শিশু শুধু সংখ্যা নয়, একটি সম্ভাবনার নাম। আমরা এখন স্কুলে ফিরে আসা শিশুদের ধরে রাখার দিকে জোর দিচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “২০২৫ সালের মধ্যে ঝরে পড়ার হার ৫%-এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি।”
শিশু ফিরলেও ধরে রাখা কঠিন
তবে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকরা বলছেন, শুধু ফেরানো নয়, শিশুদের ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক শিশু উপবৃত্তি পেলেও পরিবারের কাজে বাধ্য হয়, আবার অনেক অভিভাবক উপবৃত্তি পেলেও পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝেন না। যশোরের শার্শার এক শিক্ষক বলেন, “উপবৃত্তি পেয়ে আসে, কিন্তু পরীক্ষার সময় আসে না। আমরা শুধু টাকা দিলে চলবে না মনিটরিং, অনুপ্রেরণা ও অভিভাবক সচেতনতা দরকার।”
সুপারিশ
1. উপবৃত্তির অর্থ প্রদানের পাশাপাশি অভিভাবক কাউন্সেলিং
2. বিদ্যালয়ে মনিটরিং টিম গঠন ও স্থানীয় প্রশাসনকে সম্পৃক্তকরণ
3. ‘স্কুলে ফেরত শিশুরা কোথায়’ বিষয়ে মাসিক ফলোআপ
4. মিড ডে মিল বাধ্যতামূলক করা
5. ঝরে পড়া শিশুর তথ্যভাণ্ডার তৈরির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ
শিশুরা ফিরেছে, ক্লাসরুমে প্রাণ ফিরেছে এটা নিঃসন্দেহে একটি আশার খবর। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন টেকসই করতে হলে শুধু উপবৃত্তি নয়, চাই একটি সমাজব্যাপী সক্রিয়তা। শিক্ষা শুধু টাকা দিয়ে নয়, মনোভাব দিয়ে নিশ্চিত হয়।