কাগজে শিক্ষার্থী সংখ্যা দ্বিগুণ, অথচ ক্লাসরুমে শূন্যতা উপবৃত্তি
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১২:৩৩:১৫
কাগজে শিক্ষার্থী সংখ্যা দ্বিগুণ, অথচ ক্লাসরুমে শূন্যতা উপবৃত্তি প্রণোদনার ফাঁদে স্কুলছুট বাস্তবতা
বিশেষ অনুসন্ধান | রংপুর, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা | মে ২০২৫
সরকারি খাতায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে, উপবৃত্তির বরাদ্দও প্রতি বছর দ্বিগুণ হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে স্কুলগুলোতে ফাঁকা বেঞ্চ আর বন্ধ দরজা এই দুই বাস্তবতার সংঘাত এখনই প্রশ্ন তুলছে: এই শিক্ষার্থী কোথায় গেল? শুধু চলতি শিক্ষাবর্ষেই প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুনভাবে ভর্তি হয়েছে, যাদের একটা বড় অংশের আর কোনো উপস্থিতি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষায় এটি "ভর্তিচালিত উপবৃত্তি প্রবণতা", কিন্তু অভ্যন্তরীণ তদন্ত বলছে এর পিছনে রয়েছে গভীর অনিয়মের চক্র।
এক ক্লিকে ৩০০ টাকা, আর স্কুলে যাওয়া নয়
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে হঠাৎ করে ভর্তি হয় ৭৩ জন শিশু। মার্চের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। অথচ উপবৃত্তির তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। স্থানীয় এক অভিভাবক বলেন “শুনছিলাম মোবাইলে টাকা আসবে। তাই মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তো নাই। বই কিনার পয়সা নাই, কাজ শেখাচ্ছি।” এই বাস্তবতা শুধু বাঁশখালীতে নয়, বরং রংপুর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, বরিশালসহ ২০টির বেশি জেলায় এমন প্রবণতা স্পষ্ট।
উপবৃত্তি ব্যবস্থায় অনিয়মের পাঁচটি পর্যায়
1. ভুয়া ভর্তি: অভিভাবকের অনুরোধে বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির তদবিরে নাম অন্তর্ভুক্ত
2. নিম্নমাধ্যমিক স্তরে ভুয়া ট্রান্সফার: শিশুর নাম এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে স্থানান্তর দেখিয়ে পুনরায় উপবৃত্তি প্রাপ্তি
3. ভুয়া মোবাইল নম্বর: অভিভাবকের নামে একাধিক নম্বর ব্যবহার করে টাকার উৎস গোপন
4. শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনিয়মিত আপডেট
5. মনিটরিং ঘাটতি: উপজেলা পর্যায়ে উপস্থিতি যাচাই ব্যবস্থা দুর্বল
সরকারি ব্যাখ্যা বনাম বাস্তবতা
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিটাল মনিটরিং সেল বলছে “উপস্থিতি যাচাই এখন সফটওয়্যারের মাধ্যমে হচ্ছে। প্রতি মাসেই রিভিউ করা হয়।” কিন্তু মাঠপর্যায়ে অধিকাংশ স্কুল এখনো খাতায় উপস্থিতি নেয়, যা পরবর্তীতে সফটওয়্যারে এন্ট্রি হয় শিক্ষক বা কর্মকর্তার ইচ্ছানুযায়ী। একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, “জেলা অফিস থেকে চাপ থাকে তালিকা বড় রাখতে। কেউ কেউ আবার নিজেরাই অভিভাবকদের বলেন, ‘বাচ্চা না এলেও সমস্যা নেই, নাম থাকবে।’” শিক্ষা বিশ্লেষক ড. আফরোজা পারভীন বলেন “উপবৃত্তি ভালো উদ্যোগ, কিন্তু সেটি যদি শিশুর ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত না করে, তাহলে তা শুধুই অনুদান নয় রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।” তিনি আরও বলেন "এই প্রবণতা শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করবে, যেখানে আমরা সংখ্যা বাড়াচ্ছি, মান নয়।"
সমাধান কী?
- উপবৃত্তি প্রদানে ন্যূনতম ৭০% ক্লাস উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা
- প্রতি ত্রৈমাসিকে স্থানীয় পরিদর্শনের মাধ্যমে শারীরিক উপস্থিতি যাচাই
- বিভাগীয় অডিট টিম গঠন ও প্রকাশ্য প্রতিবেদন নিশ্চিত করা
- অভিভাবকদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা
- স্কুলভিত্তিক মনিটরিং মোবাইল অ্যাপ
একটা শিশুর নাম খাতায় থাকলেই সে শিক্ষিত হয় না যতক্ষণ না সে প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে এসে শিখছে। উপবৃত্তির এই সুযোগ যদি শিশুদের হাত না ধরে বরং অনিয়মকারীর পকেট ভরায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কেবল আর্থিক হিসেবে রয়ে যাবে, গুণগত মানে নয়।