শিক্ষক সংকট, অনিয়ম ও অবহেলায় অচল হয়ে পড়েছে শতাধিক প্রাথমিক
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১২:২৭:৪৩
শিক্ষক সংকট, অনিয়ম ও অবহেলায় অচল হয়ে পড়েছে শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়
বিশেষ প্রতিবেদন | বরিশাল, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা | মে ২০২৫
বরিশালের মুলাদী উপজেলার চরজয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসময় ১৩৫ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করত। আজ সেখানে সুনসান নীরবতা। প্রধান ফটকে তালা, চারপাশে আগাছা আর ঝরা পাতায় ভর্তি। এই চিত্র শুধু একটি স্কুলের নয় সারাদেশে এমন অচল স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। শিক্ষা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে প্রায় ১১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমানে ‘আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অচল’। অর্থাৎ সেখানে বা তো শিক্ষক নেই, না আছে নিয়মিত পাঠদান। ফলে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।
শিক্ষক না থাকলে স্কুল কিভাবে চলে?
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ২ বছরের বেশি সময় ধরে প্রধান শিক্ষক নেই। একজন সহকারী শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছিল তিনটি শ্রেণি। পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ হয়ে ছুটিতে গেলে স্কুল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় অভিভাবক সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, “স্কুলে শিক্ষক নাই, ক্লাস হয় না। শিশুরা খেলাধুলা করে ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই এখন মাঠে কাজ শেখে। পড়াশোনা যেন বিলাসিতা।”
শিক্ষার্থীর হার কমলেও প্রশাসন জানে না?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে স্কুলে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। অথচ, কোনো জেলায় এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে তালাবদ্ধ স্কুলের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। শিক্ষানীতিবিদ ড. আবদুল কাইয়ুম বলেন, “সরকার বাজেট দেয়, ভবন তোলে, কিন্তু নজরদারির অভাবে স্কুলগুলো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসন, ইউএনও বা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা যদি সক্রিয় না হন, তবে এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।” বরিশালের একটি বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের এক স্কুলে তিনজন শিক্ষকের পদ খালি আছে। পদায়ন হয় না। আবার যারা আছে তারা ট্রেনিংয়ে বা ব্যক্তিগত কারণে নিয়মিত আসেন না। আমরা লিখিত জানিয়েছি, কিন্তু সাড়া মেলেনি।” স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা, শিক্ষক পদায়নে স্বচ্ছতা না থাকা, এবং শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের অভাবে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে।
সমাধানে কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব জানিয়েছেন, “আমরা অচল বা ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়গুলোর তালিকা করছি। আগামী ৩ মাসের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ ও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে স্কুলগুলো সচল করার পরিকল্পনা রয়েছে।” তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পরিকল্পনা’ নয়, বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি।
সুপারিশসমূহ
- জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জরুরি স্কুল তালা-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা
- শিক্ষক পদায়নে স্বচ্ছতা ও অটোমেশন
- স্থানীয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্রিয়তা
- অচল স্কুলগুলোতে ‘ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক’ প্রকল্প চালু
- শিক্ষার্থী উপস্থিতির ডিজিটাল মনিটরিং
একটি শিশু স্কুলে যাবে এটা যেমন তার অধিকার, তেমনি রাষ্ট্রের দায়িত্বও। কিন্তু যদি বিদ্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলে থাকে, তাহলে উন্নয়ন কেবল ঘোষণায় আটকে যাবে। গ্রামীণ স্কুলগুলো সচল করতে না পারলে শিক্ষার মূল কাঠামোই ভেঙে পড়বে।