বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন নীতিতে ধাক্কায় বেসরকারি স্কুলগুলো!
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১১:২৮:০১
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২৫ ঘোষণার পর থেকেই দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে একধরনের অস্থিরতা। সরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে মানোন্নয়ন এবং সমতা আনার কথা বললেও, প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা পড়তে পারেন অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত সংকটে।
নীতিতে যা থাকছে
নতুন শিক্ষানীতিতে বেশ কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
একীভূত পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন (প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত)
সরকার নির্ধারিত সিলেবাস অনুসরণ বাধ্যতামূলক
প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি নির্ধারণে সরকারি নিয়ন্ত্রণ
জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার চালু
অনলাইন-অফলাইন মিশ্র পাঠদান পদ্ধতির প্রচলন
স্কুল মূল্যায়নে ‘সামাজিক নিরীক্ষা’ যুক্তকরণ
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এই নীতির লক্ষ্য হলো “শিক্ষায় বৈষম্য কমানো এবং একটি সর্বজনীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।” তবে বাস্তবে এর প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শঙ্কা
ঢাকার ধানমন্ডির একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পরিচালক বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের নিজস্ব কারিকুলাম এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষাদান করে আসছি। এখন যদি সবকিছুতেই সরকার নির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে হয়, তবে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কোথায় রইল?”ফি নির্ধারণেও নিয়ন্ত্রণ আনার প্রস্তাবকে কিছুটা অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন প্রাইভেট স্কুলগুলোর মালিকরা। একটি আন্তর্জাতিক বোর্ড ভিত্তিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, “যদি সরকারি হস্তক্ষেপে ফি নির্ধারণ হয়, তবে আমাদের উন্নত অবকাঠামো ও কোয়ালিটি শিক্ষকের বেতন মেটানো কঠিন হবে। এতে মান কমে যাবে, ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।”
একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নয়
শিক্ষানীতির খসড়া তৈরিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব না থাকার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহফুজা ইসলাম বলেন, “শিক্ষার মানোন্নয়ন অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সেটি হতে হবে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায়। প্রাইভেট শিক্ষাব্যবস্থা দেশের একটি বড় অংশে অবদান রাখছে। তাদের মতামত উপেক্ষা করলে প্রতিক্রিয়া আসতেই পারে।”
অভিভাবকদের দোটানা
অভিভাবকরা বিষয়টিকে দেখছেন দ্বিমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে। একদিকে, সরকারের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ব্যয় কমতে পারে বলে আশাবাদী অনেকে। অন্যদিকে, মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়ও রয়েছে।মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফারজানা আক্তার বলেন, “আমার সন্তানকে ভালো মানের স্কুলে পড়াচ্ছি। যদি নতুন নিয়মে স্কুল তাদের কোয়ালিটি বজায় রাখতে না পারে, তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত।”
জাতীয় শিক্ষানীতির পেছনে উদ্দেশ্য, ভালো নাকি রাজনৈতিক?
সমালোচকরা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিছু মহলের মতে, সরকার বেসরকারি শিক্ষাখাতে নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চায়, যাতে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট শিক্ষায় মান এবং সমতা নিশ্চিত করা। যারা এই পরিবর্তনে ভয় পাচ্ছেন, তারা হয়তো প্রচলিত প্রফিট মডেল হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন।”
বাস্তবতা কতটা সম্ভব?
নতুন নীতিতে একীভূত পাঠ্যক্রমের কথা বলা হলেও, আন্তর্জাতিক বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষায় এটি কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, তা নিয়েও রয়েছে বিশাল প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন শুধু কাগজে সম্ভব নয়, মাঠ পর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সহ।”
সমতা ও মানের সমন্বয়
সমালোচনার মধ্যেও কিছু শিক্ষাবিদ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন। তারা বলছেন, “এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে বরং একটি সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত।”
তারা সুপারিশ করছেন:
প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা বা ট্যাক্স সুবিধা
এক্সপেরিমেন্টাল কারিকুলাম প্রয়োগের সুযোগ
আন্তর্জাতিক শিক্ষার মান রক্ষায় বিশেষ এক্সেমশন
চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা একসাথে
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। তবে তার বাস্তবায়নে সব পক্ষের অংশগ্রহণ, সংলাপ এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ অপরিহার্য। না হলে শিক্ষার এই পরিবর্তন হবে কেবল নথিপত্রে, বাস্তবে নয়।শিক্ষা বিষয়টি একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি এখানে রাজনীতি নয়, প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি।