প্রশ্নে নয়, সংকট মানে! বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল সবখানেই ঘাটতি।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১১:১৫:১৩
প্রশ্ন উঠছে এর দায় কার? শিক্ষার্থীর? শিক্ষকতার? নাকি গোটা শিক্ষাব্যবস্থার?বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাকে বিবেচনা করা হয় উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হিসেবে। অথচ সেখানে এমন ভয়াবহ চিত্র আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষাবিদ ড. ফারজানা কবির বলছেন “যেখানে পাঠ্যপুস্তক পড়ে বোঝার চেয়ে গাইড বই মুখস্থ করাটাই প্রবণতা, সেখানে বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নে তো ফেল হবেই।”
প্রশ্নপত্র কঠিন, নাকি প্রস্তুতি দুর্বল?
প্রতিবছরই ঢাবির প্রশ্নপত্র নিয়ে চলে বিতর্ক। কেউ বলেন প্রশ্নপত্র অতিমাত্রায় বিশ্লেষণধর্মী, আবার কেউ বলেন প্রশ্ন সহজ, শিক্ষার্থীরা কেবল মানানসই নয়। ‘ক’ ইউনিটে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন “আমি কলেজে গিয়েছি নিয়মিত, কিন্তু স্যারেরা কেবল সাজেশনই দিয়েছেন। বাস্তব প্রশ্নের জন্য কেউ প্রস্তুত করেননি।” অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, “আমরা মেধার যাচাই করি। কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশ্ন দেওয়া হয়। যারা বোঝে না, তারা সফল হবে না এটাই বাস্তবতা।”
কে নিচ্ছে এই দায়?
নিম্ন ফলাফলের দায় কার এই প্রশ্নে সরকারের, শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন “আমরা পাঠ্যসূচি দিয়েছি, শিক্ষকরা পড়াবেন, শিক্ষার্থীরা বুঝে পড়বে। সবাইকে নিজের ভূমিকা বুঝতে হবে।” অন্যদিকে, শিক্ষকরা বলছেন “বেতন ১৫ হাজার টাকা পেয়ে আমরা শহরের বাইরে দিনে ৫ ঘণ্টা হাঁটে ক্লাস নিতে যাই। এরপর কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবো?”
শহর-গ্রামের বৈষম্য আরও প্রকট
ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাশ করা শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮৫% শহর বা শহরতলির ভালো মানের স্কুল-কলেজ থেকে এসেছে। অথচ, উপজেলার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী প্রথম ধাক্কাতেই বাদ পড়ে গেছে।
একজন শিক্ষক মন্তব্য করেন “আমাদের স্কুলে ল্যাব নেই, লাইব্রেরি নেই। অথচ ঢাবির প্রশ্নে থাকে গভীর বিজ্ঞান বা সাহিত্য বিশ্লেষণ। তাই মাঠে নামা ছাত্র যেন রিংয়ে উঠছে পেশাদার বক্সারের সামনে।”
কোচিং বনাম নিজস্ব জ্ঞান
ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় জয়ী হওয়ার জন্য এখন অনেকেই নির্ভর করছেন কোচিং সেন্টারের ওপর। প্রশ্ন উঠছে এই কোচিংমুখী সংস্কৃতিই কি বাস্তব শিক্ষার ক্ষতি করছে? অভিভাবকরা বলছেন, “স্কুলে কিছু শেখানো হয় না, বাধ্য হয়েই লাখ লাখ টাকা দিয়ে কোচিং করাচ্ছি।” কিন্তু কোচিংয়ের বাইরেও যাঁরা নিজের চেষ্টায় ভালো করেছেন, তাঁদের মতে, “ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোচিং ছাড়া সম্ভব। কিন্তু তার জন্য দরকার গাইডলাইন, যেটা স্কুলে মেলে না।”
শিক্ষাব্যবস্থায় ‘রিফর্ম’ কি শুধুই কাগজে?
২০২৩ সালে সরকার শিক্ষা রিফর্মের নামে জাতীয় পাঠ্যক্রমে বড় পরিবর্তন এনেছিল। ক্লাসের মূল্যায়নে পরীক্ষার চেয়ে পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বইগুলোতে যুক্ত হয় 'জ্ঞান-বিকাশমূলক' অধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে এসব কতটা কার্যকর? একজন শিক্ষার্থী বলেন “নতুন বইতে তথ্য কম, ব্যাখ্যা নেই। পরীক্ষায় এসব কিছু কাজে আসে না।” অভিভাবকদের মতে, পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না।
সমাধান কোথায়?
শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলছেন,
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের মান উন্নয়ন করতে হবে
কলেজ পর্যায়ে পাঠদানের মান বাড়াতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নপত্রের ধরন আরও স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করতে হবে
কোচিংমুখী প্রবণতা কমিয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণমুখী করে গড়ে তুলতে হবে
ড. রায়হান কবির, শিক্ষা বিশ্লেষক, বলেন “আমরা যদি বাস্তব শিক্ষার পরিবেশ না দেই, তবে কোন পরীক্ষাতেই সফল হব না বিশ্ববিদ্যালয় হোক, চাকরি হোক বা জীবন।" ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ৮% পাশ মানেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক সংকেত। এতে ছাত্রদের ‘অযোগ্য’ বলার আগে, আমাদের দেখতে হবে তারা কতটা ‘প্রস্তুত’ ছিল, এবং কেন তা ছিল না। তাদের ব্যর্থতা নয়, আমাদের সিস্টেমের সীমাবদ্ধতাই বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।