ন্যায়বিচার না ‘নিরাপত্তা রায়’? গণমাধ্যমের আলোয় বিচারের গতি।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১১:৪৯:২৬
রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকা থেকে এক কলেজছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার হয়। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যক্তিগত একটি ভিডিও ও কিছু চ্যাটলগ। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবে শুরু হয় বিতর্ক, ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ, এবং মিডিয়া চাপে একপ্রকার ‘আতঙ্কিত বিচার’ প্রক্রিয়া। পুলিশ দ্রুত গ্রেফতার করে তার প্রেমিক ও দুই বন্ধুকে, মামলা গঠন হয় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে (ফৌজদারি আইন ৩০৬ ধারা)।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই দ্রুততা কি বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে, না মিডিয়া ও জনমতের চাপেই?
সাধারণত বিচারপ্রক্রিয়া হয়ে থাকে তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, এবং আইনি ধাপসমূহের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আলোচিত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, গণমাধ্যম ‘অভিযুক্ত’ চিহ্নিত করে দেয় ঘটনার আগেই।
“তদন্তে যদি মূল তথ্য উপেক্ষিত হয়, মিডিয়ার চাপে যদি প্রমাণবিহীন অভিযোগে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাহলে সেটি ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।” একই সঙ্গে আদালত নির্দেশ দেয় পুনরায় ডিজিটাল প্রমাণ বিশ্লেষণ ও নতুন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করতে।
এই প্রজন্মের বিচার ব্যবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়া এক ধরনের ‘জন আদালত’ তৈরি করেছে। একদিকে যেখানে এটি সচেতনতা বাড়ায়, অন্যদিকে দ্রুত ‘প্রেসার কুকার’ পরিস্থিতি তৈরি করে তদন্তকারী সংস্থার ওপর।মনোবিজ্ঞানী ড. লুবনা শারমিন বলেন,“গণমাধ্যমে অভিযুক্তকে দোষী চিহ্নিত করার প্রভাব পড়ে তদন্তের মানসিকতায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের স্বচ্ছতা নয়, বরং দ্রুত চার্জশিটকে প্রধান করে তোলেন।”
বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি মিডিয়ার সামনে ‘লাইভ’ হওয়ায় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। ভিডিও ফুটেজ, স্ত্রীর কান্না এবং মিডিয়ার তুমুল চাপের মুখে ১৫ দিনের মধ্যে ২৪ জনের নামে চার্জশিট গঠন হয়। পরবর্তী বিচারে দেখা যায়, কয়েকজন অভিযুক্তের সম্পৃক্ততা সন্দেহজনক ছিল।
সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা বেগম বলেন,“দ্রুততা সবসময় ন্যায়বিচার নয়। তদন্তকে মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল করে তুললে, সেখানে যুক্তি নয়, আবেগ চলে আসে।”
এই ধরনের ঘটনায় মূলত ব্যবহার হয়:
এছাড়াও, গণমাধ্যমে চলমান ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর উপর নজরদারির জন্য আইনি বিশেষজ্ঞরা সুপ্রিম কোর্টের নজিরবিহীন নির্দেশনার দাবি তুলছেন।
দ্রুত বিচার না প্রতীকী রায় সমাজ কোনটায় আস্থা রাখে?
আলোচিত মামলাগুলোতে দ্রুততা দেখে কিছুটা স্বস্তি আসলেও, গভীরে গিয়ে দেখা যায় বিচার যেন হয়ে উঠছে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী ‘আবেগের প্রতিক্রিয়া’।
ন্যায়বিচার তখনই হয়, যখন তদন্ত হয় নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক এবং মিডিয়ার প্রভাবমুক্ত।
গণমাধ্যম সচেতনতা তৈরি করুক, কিন্তু যেন বিচারকের জায়গা না নেয় এই বার্তাটিই সমাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।