প্রকাশিত : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ৪:৫৩:৩৬
প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো মিশরের ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অব খুফুর’। এই স্থাপত্যটির কাছেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে দ্য গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের (জিইএম)। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বলা হচ্ছে, যেখানে এক লাখেরও বেশি প্রত্নসামগ্রী রাখা হয়েছে। প্রাক-রাজবংশীয় সময়ে থেকে গ্রিক ও রোমান যুগ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার বছরের ইতিহাস সেখানে ঠাঁই পেয়েছে। খবর বিবিসির।
বিখ্যাত মিশরবিদরা বলছেন, এই জাদুঘর চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে অন্য দেশে থাকা মিশরের প্রত্নসামগ্রী ফিরিয়ে আনার দাবি জোরদার হবে। এর মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে থাকা ‘রোসেট্টা স্টোন’ও রয়েছে। তবে দ্যা গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম সবচেয়ে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো প্রাচীন মিশরের বালক সম্রাট তুতেনখামুনের অক্ষত সমাধি থেকে পাওয়া পুরো সংগ্রহের একসঙ্গে প্রদর্শন।
ব্রিটিশ মিশরবিদ হাওয়ার্ড কার্টার এটি আবিষ্কারের পর এই প্রথম এটি প্রদর্শিত হচ্ছে। এই পুরো সংগ্রহের মধ্যে আছে তুতেনখামুনের দর্শনীয় সোনার মুখোশ, সিংহাসন ও রথসহ মূল্যবান সব সামগ্রী।
আন্তর্জাতিক মিশরবিদ সমিতির সভাপতি ও গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের সাবেক প্রধান ড. তারেক তৌফিক বলেন, ‘কীভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে। কারণ সমাধিটি ১৯২২ সালে আবিষ্কারের পর এর সাড়ে ৫ হাজার সামগ্রীর মধ্যে ১ হাজার ৮০০-র বেশি প্রদর্শন করা হয়েছে। আমার ধারণায় ছিল পুরো সমাধি সংগ্রহ প্রদর্শন। অর্থাৎ কিছুই আর গুদামে বা অন্য জাদুঘরে থাকবে না। যাতে শত বছর আগে হাওয়ার্ড কার্টার যেভাবে পেয়েছিলেন আপনি সেভাবেই তা দেখতে পারেন।’

প্রায় ১২’শ কোটি ডলার (১.২ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে তৈরি করা এই জাদুঘর বছরে অন্তত ৮০ লাখ দর্শনার্থী দেখতে পারবেন। এটি মিশরের পর্যটনকে চাঙ্গা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। গিজা পিরামিডের একজন গাইড আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘দ্য গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম মিশরবিদ্যা ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের নতুন সোনালী যুগের সূচনা করবে বলে আমরা আশা করি’।
তুতেনখামুনের প্রদর্শনী আর খুফুর সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকা বাদ দিয়ে গ্যালারির বেশিরভাগ সামগ্রী গত বছর থেকেই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা আছে। তিনি আরও বলেন, ‘আংশিক খোলা সত্ত্বেও আমি জাদুঘরে অনেকগুলো ট্যুরের আয়োজন করেছি। এখন এটি গৌরবের চূড়ায় পৌঁছাবে। যখন তুতেনখামুনের সংগ্রহ খোলা হবে তখন আপনি কল্পনা করতে পারবেন যে পুরো পৃথিবী ফিরে এসেছে। কারণ এটা একটি আইকনিক ফারাও তথা সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা।
লন্ডন থেকে ভ্রমণে আসা স্যাম বলছিলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়ে মিশরের প্রত্নসামগ্রী দেখার জন্য অপেক্ষা করছি’। আরেকজন ব্রিটিশ পর্যটক বলছিলেন যে, তিনি এর আগে তাহরির স্কোয়ারে নিওক্লাসিক্যাল মিশরীয় জাদুঘরে তুতেনখামুনের প্রদর্শনী দেখেছিলেন।
নতুন তৈরি হওয়া জাদুঘর প্রায় ৫ লাখ বর্গমিটারের, যা ৭০টি ফুটবল মাঠের সমান। দেয়ালে খোদাই করা হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় লিপি। অ্যালাবাস্টার পাথরের ত্রিভুজাকার নকশা আর প্রবেশদ্বারে করা হয়েছে পিরামিড আকৃতির। এই জাদুঘরে আছে ৩২’শ বছরের পুরনো পুরোনো ও ১১ মিটার লম্বা মূর্তিটি সবচেয়ে বিখ্যাত ফারাও (সম্রাট) রামেসিস দ্য গ্রেটের। এটি ২০০৬ সালে কায়রো রেল স্টেশনের কাছ থেকে নতুন জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছিল।

বিশাল সিড়ির কাছে প্রাচীন রাজা রাণীদের মূর্তি ও উপরের তলায় বিশাল জানালা থেকে দেখা যাবে গিজা পিরামিড। নতুন এই জাদুঘরটির প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। আর নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালে। ধারণা করা হয়, এটি নির্মাণ শেষ করতে পিরামিড নির্মাণের মতো সময় লেগেছে। তবে এই প্রকল্প বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময়, পরে কোভিড মহামারী ও আঞ্চলিক যুদ্ধগুলোর সময়ে।
মিশরের দীর্ঘদিনের পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ড. জাহিদ হাওয়াস বলেন, ‘এটা ছিল আমার স্বপ্ন। জাদুঘর পুরোপুরি চালু হয়েছে দেখে আমি সত্যিই খুশি। এখন আমি দুটি জিনিস চাই- প্রথমত, জাদুঘরগুলো চুরি করা প্রত্নবস্তু কেনা বন্ধ করুক; দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ মিউজিয়াম থাকা রোজেটা স্টোন, লুভ জাদুঘরে থাকা ডেনডেরা জোডিয়াক, এবং বার্লিন থেকে নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তি ফিরে আসুক।’

দ্য রোসেট্টা স্টোন ১৯৯৯ সালে পাওয়া গিয়েছিল। এটি হায়রোগ্লিফিকস পাঠোদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। ফরাসি সেনারা এটি আবিস্কার করে। তবে পরে ব্রিটিশরা যুদ্ধের পর দখল করে নেয়। অন্যদিকে ডেনডেরা জোডিয়াক একটি প্রাচীন মিশরীয় আকাশ মানচিত্র। ১৮২১ সালে ফরাসিরা একটি মন্দির থেকে এটি কেটে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া মিশরের অভিযোগ জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের ফারাও আখেনাতেনের স্ত্রী নেফারতিরির মূর্তি পাচার করে নিয়ে গিয়েছিল।
ড. হাওয়াস বলেন, ‘ওই তিন দেশ থেকে এগুলো ফিরিয়ে আনা দরকার উপহার হিসেবে। মিশর বিশ্বকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে।’
তবে ব্রিটিশ জাদুঘর বিবিসিকে বলেছে, তারা এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাননি।